SANTHALDISHOM(সানতাল দিশোম): October 2018

Tuesday 23 October 2018

মহিষাসুর ও হুদুড় দুর্গা কি একেই ব্যক্তি ?




প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে, কলকাতা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে পশ্চিমবাংলার বুকে দুর্গাপুজোকে ঘিরেই এক অন্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। পুরুলিয়া জেলার এক অখ্যাত গ্রামে আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে, নিজেদের আত্মপরিচয় তুলে ধরতে, নিজেদের মর্যাদাকে মান্যতা দিতে এই দেশের ভূমিপূত্র খেরওয়াল আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠান “দিশম খেরওয়াল বীর কালচার কমিটি”-র পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘হুদুড় দুর্গা (মহিষাসুর) স্মরণ দিবস’। ২০১১ সাল সেটা। সোনাইজুড়ি গ্রামে (কাশীপুর থানার অন্তর্গত) এক তরুণ অজিতপ্রসাদ হেমব্রম এবং তাঁর সহকারী চারিয়ান মাহাতোর উদ্যোগে ঘটে এই পুজো। নিজেদের সংস্কৃতির মৌখিক উপাদানকে সংগ্রহ করেই চারিয়ান মাহাতোর কলম থেকে শহিদ স্মরণ দিবসকে উপলক্ষ করে একটি তীক্ষ্ণ রচনা বেরিয়ে আসে স্থানীয় একটি পত্রিকায়। সে লেখার নাম ছিল ‘হুদুড় দুর্গা’।
কাজটা সহজ ছিল না। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনেক চাপ, এমনকি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়েছিল এই দুই তরুণকে। আশ্চর্য নয়, সোনাইজুড়িতে সে দিন যে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল তা আজ ঢুকে পড়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও। তার ঢেউ থেকে বাদ যায়নি সংসদও। গত বছর সংসদে ‘মহিষাসুর’ বিতর্কের কথা কম বেশি সকলেই আমরা শুনেছি।
কে এই ‘হুদুড় দুর্গা’? কী জন্যই বা এই হুদুড় দুর্গা স্মরণ দিবসের আয়োজন? কেন হঠাৎ করে এর প্রচার বা প্রসার? এত তাড়াতাড়ি এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লই বা কেন?
আসলে ‘হুদুড়’ কথার অর্থ ‘বজ্রের মতো তেজ বা শক্তি যার।’ আর দুর্গার অর্থ? ‘দুর্গ রক্ষা করেন যিনি’। এই দেশের ভূমিপূত্রদের কাছে হুদুড় দুর্গা এক জনপ্রিয় শাসক, প্রজাদের রক্ষাকর্তা, তাদের কল্যান চিন্তক। অনেকেই তাকে আবার মহিষাসুর বলে চিহ্নিত করেন। যে অসুরের বিনাশ চান আমাদের উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। আমরা অনেকেই জানি না যে ‘অসুর’ নামে বাস্তবে এক উপজাতি আমাদের ‍দেশে এখনও আছে। তারা এখনও ঝাড়খণ্ডের কিছু অঞ্চলে এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা। মহীশূরের বিভিন্ন জায়গাতেও শহর থেকে দূরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বসবাস করে তারা। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই অসুর জাতির সদস্য সংখ্যা ৪০০০-এর কিছু বেশি। এমনকি আলিপুরদুয়ারে একটা আস্ত গ্রামের নামই অসুর গ্রাম। অতি আশ্চর্য এবং একই সঙ্গে দুঃখের বিষয়, ‍বিখ্যাত মণ্ডল কমিশন রিপোর্টে প্রকাশিত যে তফশিলি জনজাতিদের তালিকা আছে, তার প্রথম জনজাতিই ‘অসুর’, অথচ এ কথা এত কম লোক জানেন।
লোককথা অনুসারে, এই অসুর জাতি তাদের মহান রাজা ‘মহিষাসুর’ বা ‘ঘোরাসুর’ -এর‍ অন্যায় নিধন মেনে নিতে পারেনি। নিরীহ আদিম অধিবাসীদের উপর বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ নেমে আসে। আদিবাসীদের বসবাস করার জায়গা ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করা চাষের জমি তারা দখল ক‍রে নিতে এসেছিল। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বহিরাগত আর্যশক্তি দৈহিক দিক থেকে বলীয়ান না হলেও বুদ্ধির দিক থেকে ছিল অনেক বেশি উন্নত। তাই বার বার যুদ্ধ করেও যখন তারা আদিম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারল না, তখন কূটকৌশল প্রয়োগ করে তারা জয়লাভ করে। বীরের যুদ্ধ থেকে সরে এসে তারা ভূমিপুত্রদের দুর্বল জায়গাটি অবশেষে খুঁজে বার করে। দেখে যে, আদিম জাতির সমাজে মহিলাদের স্থান অনেক উপরে; তারা সম্মাননীয়া, তারা পূজিতা। (আজকের দিনেও খেড়ওয়াল আদিবাসী যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা বা ওরাওঁ জনজাতিদের মধ্যে পণপ্রথা প্রচলিত নেই— তাদের বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে গিয়ে নিজেরাই রান্না করে খায়।) আর্যরা তাই মহান বীর মহিষাসুর বা ঘোরাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক নারীকে প্রেরণ করেছিল। তারা ভাল ভাবেই জানত, আদিম জনজাতিদের প্রথা অনুযায়ী মহিষাসুর কখনওই নারী বা শিশুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। সুযোগ বুঝে তাই সেই নারীকে কান্ডারি করে অনার্যদের মহান নেতা মহিষাসুর এবং এখানকার ভূমিপূত্রদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে তারা। এই রকম অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক দিন ভূমিপুত্র আদিবাসী খেড়ওয়ালরা তাদের ক্ষমতা হারায়, যে দুঃখ আজও তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালি উচ্চবর্ণীয় নাগরিক সমাজ যখন দুর্গাপূজায় মেতে থাকে, অসুরদের বিনাশ চায়, আলিপুরদুয়ারে অসুর প্রজাতির লোকেরা নিজেদের কুঠুরিতে আবদ্ধ রাখে পূজার কয়েকটা দিন।
অন্য দিক দিয়ে ভাবতে গেলে বোঝা যায়, যে মহিষাসুর ওতপ্রোত ভাবে মহিষের সঙ্গে জড়িত (মহিষকেই মহিষাসুরের বাহন হিসেবে দেখানো হয়), গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্য জাতির কাছে সে খুব আপন হবেই। তাই দুর্গাপূজার পনেরো দিন পরেই আদিম অধিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পূজা বা বন্দনা হয়। ভাবতে অসুবিধা হয় না, কেন গ্রামবাংলাতে আদিবাসীদের কাছে মহিষাসুর নায়ক হতে পারেন।
উল্টো দিকে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ বা আর্য সমাজে অসুর জাতি মানেই‍ ‘অ-সভ্য’ জাতি। অভিনব বাংলা অভিধানে ‘সাঁওতাল’ শব্দের অর্থও এই ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘সাঁওতাল পরগনার আদিম অধিবাসী; অসভ্য জাতিবিশেষ’। যে ‘দুর্গা’কে কেন্দ্র করে এত ধুমধাম, তিনিই বা কে? অসভ্য জাতি বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদের সমাজে দুর্গা নামে কোনও মহিলা নেই। দুর্গাকে তারা পুংলিঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করে, এবং তাদের ছেলেদের নামকরণ করা হয় দুর্গা নামে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই জাতির লোকেরা তাদের নায়ক মহিষাসুরকেই ‘হুদুড় দুর্গা’ বলে ডাকে।
এই যে বিচিত্র ঐতিহ্য আমাদের রাজ্যেরই সংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ কি কোনও দিন তার কথা শুনতে চায়? না। এই সব সংস্কৃতিকে দমিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা চলছে সেই আদিকাল থেকেই। ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ ইত্যাদি আমরা মুখে বলি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচিত্রতার ধারা আমরা রক্ষা করে চলি না, এমনকি তাদের ন্যূনতম সম্মানও রক্ষা করি না। কে বলতে পারে এই বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা বা তাদের কথা না-শোনার ফলেই উল্টো দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, হিংসাবাদী ইত্যাদির উত্থান হয়নি? ছত্তীসগঢ়ে তো আজও মাওবাদী দমনের নামে চলে আসছে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন।
নাগরিক সমাজ যখন তাদের শারদীয়া পূজায় আনন্দে মাতে, তখন তাই দুর্গার এই অন্য ঐতিহ্যটিও স্মরণে রাখা জরুরি। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে জয়ধ্বনি দিয়ে, এবং তাকে উপলক্ষ করে ‘অসুর’ নামক একটা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বুকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ না করাটা জরুরি। আদিম অধিবাসীরা হয়তো বলবেন, আপনাদের শারদীয়ার আনন্দ আমরা কেড়ে নিতে চাই না, কেবল পদতল থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক আমাদের মহান নেতা মহিষাসুরকে। প্রসঙ্গত, আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত খেড়ওয়াল আদিবাসীর (মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতি) পুরুষরা সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে ‘দাঁশাই নাচ’-এর ‍মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস করে। তাদের ‘হায় রে! হায় রে!’ আর্তনাদে, তাদের মহান নায়কের বীরগাথার মধ্যেই হয়তো প্রকাশিত হয় মানুষ হিসেবে তাদের নিজেদের সুগভীর বঞ্চনা ও অবহেলার ক্ষোভ!
গণতান্ত্রিক দেশে যে আজও আদিবাসী মানুষ তাদের নিজেদের সংস্কৃতির মর্যাদা না পেয়ে ক্ষুব্ধ, এ আমাদের দেশেরই লজ্জা। সংবিধানিক অধিকার তাদেরও জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু মানবিক মর্যাদা তারা এখনও পায়নি, এই এক মহিষাসুর বৃত্তান্ত থেকেই তা বোঝা সম্ভব। আমরা যেখানে সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে থাকার গর্বে আটখানা, সেখানে আমরা কি পারি না, আমাদের পার্বণের নামে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আঘাত না করতে? তাদের কোনও ভাবে অপমান বা অসম্মান না করতে? যদি পারতাম, আমাদের পার্বণই হয়তো শুদ্ধতর হতে পারত। আরও শুভও হতে পারত।
আজও মহিষ রাজার এলাকা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের লাতেহার জেলার নেতারহাট শহর সংলগ্ন গ্রাম ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাটে মহিষাসুর দেবতা জ্ঞানে পূজিত হন। এই লাল মাটির জঙ্গলে বসবাস অসুর সম্প্রদায়ের। এই সব গ্রামগুলিতে বসবাস অনিল অসুর, ললিত অসুর, সুষমা অসুরদের বাস। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে অনেকের ঘরেই আলো জ্বলে না, গায়ে নতুন কাপড় ওঠে না। তাঁদের পূর্বপুরুষ মহিষ রাজাকে দুর্গা নামে বহিরাগত এক সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে অশৌচ পালনের দিন।
ঠিক কী ছিলেন এই মহিষ রাজা? স্বর্গ-মর্ত তছনছ করে দেওয়া এক ভয়ংকর অসুর, যাঁর হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু সব দেবতাকে নিজের শক্তি দিয়ে ডাকতে হল মহামায়াকে? না কি প্রজাপালক এক নৃপতি, যাঁকে নারীর মোহিনী মায়ায় বশ হয়ে শেষ অবধি মৃত্যু বরণ করতে হল? অসুরই বা কারা? দেবতাদের স্বর্গরাজ্য বা মুনিঋষিদের তপোবনে সন্ত্রাসের হানা দেয় যারা?
কিন্তু ঋগ্বেদ তো উলটো কথাই বলছে। মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্র সব বৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সবিতৃ বা সূর্যদেবও ‘সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।’ ঋগ্বেদই জানিয়ে দিল, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়। শক্তিমান এক পুরুষ।
এই ক্ষমতাশালী অসুর-পুরুষ আসলে বিশ্বস্রষ্টা। পার্সি ধর্মের ‘জেন্দ আবেস্তা’র একমাত্র ঈশ্বর: আহুর মজদা। ম্যাক্সমুলার থেকে মনিয়ের উইলিয়াম্স, অনেকেই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, আহুর এবং বৈদিক সংস্কৃতির অসুর অনেকটা এক। খ্রিস্টের জন্মের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ইরাকের কাছে যে আসিরীয় সভ্যতা ছিল, সেখানেও ছিলেন এই আহুর মজদা। আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের এক শিলালিপিতে কিউনিফর্ম সংকেতে রয়েছে ‘আসুর মজদা’র উল্লেখ।
শিলালিপিটা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে আসুরবানিপাল আসিরিয়ার রাজা হয়েছিলেন। শিলাপটে তাঁর সিংহ শিকারের কিছু ছবিও রয়েছে। মহিষ রাজার খোঁজে এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বে সিংহশিকারী এক নৃপতিকে পাওয়া গেল। ভাষাতত্ত্বের খেলায় প্রাচীন আসিরিয়া, অসুর এবং আহুর একদেহে হল লীন।
অসুরেরাও দেবতা। প্রমাণ: রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। সেখানে দেবতা ও অসুর দু’পক্ষই প্রজাপতির পুত্র, বৈমাত্রেয় ভাই। ইন্দ্রের শ্বশুরমশাই পুলোমা এক অসুর। ভক্ত প্রহ্লাদও হিরণ্যকশিপু নামে এক অসুরের পুত্র। কশ্যপ ঋষির ছেলে ময় দানব হয়েও দেবতাদের অলকাপুরী নির্মাণ করে। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদও বানায়। তার বউ এক অপ্সরা, নাম হেমা। দেবাসুরের সংগ্রাম তাই শুধুই যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীসংঘর্ষের কাহিনি নয়। সকলেই আত্মীয়, তাদের মধ্যে বিয়ে-থা’ও হয়।
মহিষ রাজার খোঁজে বেরিয়ে সেই শক্তিমান অসুর পুরুষকে পাওয়া যায় মহীশূরের চামুণ্ডি পাহাড়ে। মহিষাসুর আর তাঁর দুই সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে এই পাহাড়েই বধ করেছিলেন দুর্গা। মহিষাসুর থেকেই কালে কালে অপভ্রংশে মহীশূর নাম। চামুণ্ডি মন্দিরের প্রবেশচত্বরেই বিশাল মূর্তি। গোঁফ ও গালপাট্টাসহ রাজার মতো দাঁড়িয়ে, এক হাতে খড়্গ, আর এক হাতে সাপ। মহিষাসুর মানেই সিংহের আক্রমণে ত্রস্ত, দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ কোনও মহিষরূপী দানব নয়।
খুঁজতে খুঁজতে মহিষ রাজার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের পাওয়া যাবে এই পশ্চিমবাংলায়ও। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানে। বাগানের শেষ প্রান্তের কারি লাইনে রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা খুড়ো অসুর জানালেন, ‘দুর্গাপুজোয় আমরা যোগ দিই না, কারণ সেখানে মহিষাসুরকে হত্যা করা হয়েছিল। সে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল।’
এই অসুরেরা সকলেই ঝুপড়িতে থাকেন। মহিলারা বাগানে চা-পাতা তোলেন, পুরুষেরা বেশির ভাগ সময় দিনমজুরের কাজে ভুটান চলে যান। সেখানে দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরি। কেউ আবার ভুটান থেকে আসা বস্তায় বাঁধা কাঁচা সুপারি গাড়িতে তোলার কাজ করেন। মেটেলি আর মালবাজারের চা-বাগানে আরও কয়েক ঘর অসুর আছেন। সেখানেই ওঁরা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতান।
কিন্তু ধর্ম? ১৮৮০ সালে ক্যারন চা-বাগানের পত্তন। সেই সময় রাঁচি ও ছোটনাগপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুলির কাজে নিয়ে আসা হয় ওঁদের। আগে জঙ্গলে শিকারও করতেন, নিজেদের হিন্দু এবং শিবের উপাসক বলে পরিচয় দিতেন। মহিষাসুরের উত্তরাধিকারী আদিবাসী অসুর এবং শিবপুজো করা কিরাতদের একাকার হওয়াতেই ভারতীয় ঐতিহ্য।
চা বাগানের ১০১টি অসুর-ঘরের মধ্যে ৯০টিই আজ খ্রিস্টান। ৮০ বছরের বর্গী অসুরের ছেলে ও নাতিরা যেমন! ‘আমি নতুন জীবনে গিয়ে হয়তো মানাতে পারব না। ছেলেপুলেরা বাগানে পাতা তোলে, আমিও আজীবন ওই কাজটাই করেছি। নতুন ধর্ম যদি ওদের একটু ভাল রাখে!’
চা বাগানের শেড ট্রিতে বসে বর্গী বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় দুর্গাপুজোটা খুব খারাপ লাগত। চার দিকে হইচই, কিন্তু মা আমাদের ঘরের বাইরে বেরোতে দিত না। বলত, বেরোলেই অলুক্ষুণে কিছু ঘটবে। পরে দেখলাম, বন্ধুবান্ধবরাও আমার পদবি নিয়ে ঠাট্টা করে। এখন আমরা আর কিছু লুকোই না। বছরে দু’বার, ফাল্গুন মাসে আর দশেরায় আমরা অসুরবাবার পুজো করি।’ বর্গীর পাশের বাড়ির তরুণী ললিতা অসুর শুনতে শুনতে পালটা ঝাঁজি মেরে উঠল, ‘আ মোলো! আমি মহিষাসুরের বংশধর হতে যাব কেন? আমাদের এখানে তো অনেকে টোপো, কাজুর এ সব পদবিও নিয়েছে গো!’
মহল্লার একমাত্র অনসুর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জগন্নাথ মাহাতো। সবাই ডাকে মাস্টারজি বলে। তাঁর আক্ষেপ, ‘ওরা আজকাল অনেক বদলে গিয়েছে। আগে শিকার করে অনেক মাংসই খেত, এখন রান্নার ধরনধারনও তেল-হলুদ-সর্ষেবাটা দিয়ে আমাদের মতোই।’
শুধুই রন্ধন এবং ধর্মসংস্কৃতি নয়। একশো-দেড়শো বছর ধরে বিভিন্ন চা-বাগান ও খাদানের কুলি লাইনে হতদরিদ্র অভিবাসী হতে হতে অসুরেরা হারিয়েছেন নিজস্ব ভাষা। ১৮৭২ সালের জনগণনায় ১৮টি জনজাতির কথা বলা হয়। সবচেয়ে বেশি লোক ছিলেন অসুরদের মধ্যে। ১৭৪ বছর পর সেই অসুরেরা আজ ঝাড়খণ্ডের এক ‘আদিম জনজাতি’ — প্রিমিটিভ ট্রাইব। তাঁদের বেশির ভাগ সময় মুণ্ডাদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, আসুরি ভাষাকে মুণ্ডারি উপভাষার মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তিন বছর আগেও গণেশ দাভি-র ‘পিপ্‌লস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, আসুরি সহ ভারতের প্রায় দেড়শোটি ভাষা ধ্বংসের মুখে। মহিষ রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ট্র্যাজেডি ক্রমে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। অবহেলায় কী ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই দেশের আদি বাসিন্দা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা, গান, উপকথার মৌখিক সংস্কৃতি।
পশ্চিমবঙ্গও এ ব্যাপারে সমান দায়ী। ২০১৫ সালে পুরুলিয়ায় যখন চরণ মাহাতো, সুষেণজিৎ বৈরাগীরা ‘মহিষাসুর দিবস’ পালন করছিলেন, পুজো মণ্ডপে এসে স্থানীয় পুলিশ অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে। সুষেণের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘প্রিয়জন মারা গেলে আজকাল পুলিশের থেকে অশৌচেরও অনুমতি নিতে হয়?’ পুলিশ কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। সিধু-কানুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করলেই হয় না, আদিবাসীদের বিপন্ন সংস্কৃতির কথাও বুঝতে হয়।
সেই সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছিলেন রাঁচির সমাজকর্মী, ‘ঝাড়খণ্ডী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আখড়া’র বন্দনা টেটে, ‘শুধু অসুর নয়, সাঁওতাল এবং পোকরুদের উপকথাতেও মহিষ রাজা এবং দুর্গা তাকে কী ভাবে মোহিনী রূপে ভুলিয়ে ভালিয়ে বধ করলেন, সেই গল্প পাবেন।’ এই আখড়া বা পরিষদের তরুণী সুষমা অসুরই আসুরি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত কবি। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল্যাংগোয়েজ ফেস্টিভ্যালে তাঁর কবিতার বই ‘অসুর সিরিং’ নিয়ে গিয়েছিলেন: ‘খেতো মে যব হুল চলাওগে/ তব ধান বোয়েগে/ নহি তো ঘাস আ জায়েগা।’ রাঁচি, নেতারহাটের মালভূমিতে রোজকার হতদরিদ্র জীবন নিয়ে একটি মেয়ের কবিতা। সুষমারা সম্প্রতি ফেসবুকে ‘অসুর আদিবাসী ডকুমেন্টেশন ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি ওয়েব পেজও খুলেছেন। মহিষ রাজার উত্তর প্রজন্মে ক্লাস টুয়েল্ভ পাশ এক মেয়ে কবিতা লিখে, সংগঠন তৈরি করে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একুশ শতকের দশভুজা।
সুষমা নিজে শাখুয়াপানি গ্রামের মেয়ে, বলছিলেন, দুর্গাপুজো বা নবরাত্রিতে তাঁরা যে অশৌচ পালন করেন, তাকে মহিষাসুর দশা বলে। দীপাবলিকে তাঁরা বলেন সোহরাই (বা সহরায়), ওই সময় নাভিতে, বুকে ও নাকে করঞ্জী ফুলের তেল লাগান। ‘ওই তিন জায়গাতেই আমাদের পূর্বপুরুষ ত্রিশূলবিদ্ধ হয়েছিলেন, রক্ত ঝরেছিল।’ মাংস বা হাঁড়িয়ার পাশাপাশি সুষমারা ওই সময়ে শশাও খান। শশা নাকি মহিষ রাজাকে খুন করা সেই ছলনাময়ীর হৃদয়ের প্রতীক। গ্রামের লোকেরা গরুর দুধ খায় না, ‘আমরা চাই বাছুরেরা বরং মায়ের দুধ খেয়ে তাগড়াই হয়ে উঠুক, যাতে তাদের জোতের কাজে লাগানো যায়।’
জোত আর কোথায়? গ্রামের বেশির ভাগ লোক এখন বক্সাইটের খাদানে কাজ করেন। এ গ্রামে একটাই প্রাথমিক বিদ্যালয়। নেই কোনও হাসপাতাল। বছর কয়েক আগে সুষমার বাবা অসুস্থ হলে তাঁকে দু’ঘণ্টা দূরে লোহারদাগা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার নেই। আরও দুই ঘণ্টা দূরে গুমলায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই মৃত্যু। অসুরনিধনের গল্প ফুরোয়নি।
গুমলার গুরুত্ব শুধু বড় হাসপাতালে নয়। ঝোবিপাট গ্রামের ললিত অসুর, সুখনা অসুরেরা বলছিলেন তাঁদের আসুরি উপকথা। সেখানে মহিষাসুর এলাকার রাজা। দেবতাদের সঙ্গে তার বিশেষ বনে না। দেবতারা তাদের বন্ধু দুর্গার শরণাপন্ন হয়। তারা জানত, রূপযৌবন আর ছলাকলায় দুর্গা সবাইকে ভোলাতে পারে। ফলে মহিষ রাজাকে ফাঁদে ফেলা যাক! এক দিন রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে চলেছিল লোহা গলানোর কাজে। সুন্দরী দুর্গা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। কাজ ফেলে মহিষাসুর তার সঙ্গে চলে যায়।
অতঃপর ভেসে যায় আদরের নৌকো। সুন্দরী দুর্গা প্রেমিককে কখনও নিয়ে যায় নদীর ধারে, কখনও বা হাঁড়িয়ার ভাটিখানায়। মহিষাসুরকে তার অস্ত্রগুলিও মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য করে সে। তার পর এক দিন নিরস্ত্র প্রেমিককে মেরে ফেলে। ‘গুমলার টাঙিনাথ পাহাড়ের মাটিতে এখনও বড় বড় অনেক অস্ত্র পোঁতা রয়েছে। অনেক বার মাটি খুঁড়ে ঢাউস তলোয়ার, ত্রিশূল মিলেছে। অসুরবাবাকে ওখানেই মেরে ফেলেছিল’, জানালেন অনিল অসুর।
লোহা গলিয়ে মহিষাসুরের অস্ত্র! প্রত্নতাত্ত্বিকদের একাংশ আজও বলেন, অসুর উপজাতি সাবেক মগধ, পাটলিপুত্রে লোহা গলানোর কাজ করত। সেই বিদ্যায় তারা যে কত দূর এগিয়েছিল, অশোকস্তম্ভগুলিই নাকি তার প্রমাণ। সেই সব লোহায় আজও মরচে পড়েনি। সেই প্রযুক্তিবিদ্যার স্বীকৃতি আজও মিলল না, শুধু জনজাতির ওরাল ট্র্যাডিশনেই রয়ে গেল!
এক এক জনজাতির এক এক উপকথা, ঐতিহ্য। কিন্তু সাঁওতাল, মুণ্ডা, অসুর — প্রতিটি আদিবাসী জনজাতিতেই রয়েছে জনপ্রিয় মহিষ রাজা ও ছলনাময়ী এক নারীর উপাখ্যান। মহিষ রাজার মাথায় মোটেই শিং ছিল না, তিনি লোহা গলাতেন, প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। নবরাত্রির সময় আজও সাঁওতালরা তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। যখন পায় না, একটা খড়, মাটির কাঠামো ভেঙে দেয়। সাঁওতালি উৎসবের এই হারিয়ে-যাওয়া রাজা বা ‘হুদুর দুর্গা’-তে আজও মহিষরাজার স্মৃতি অম্লান। মুণ্ডারি উপকথায় আছে, জঙ্গলে এক বুনো মোষ খুঁজে পেল ছোট্ট এক মেয়েকে। তাকে যত্নে বড় করে তুলল সে, মেয়েটি ক্রমে পরমাসুন্দরী যুবতী হয়ে উঠল। রাজা তাকে তুলে নিয়ে যেতে লোক পাঠাল, মোষ তাদের গুঁতিয়ে ছারখার করে দিল। অতঃপর রাজার লোকে মোষকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। মোষ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মারা গেল। রাজা মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেল। মহিষাসুর বধের বিকল্প আখ্যান?
সবাই জানে, অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে, দেবতারাই জয়ী হয়েছিলেন। দেবীর সেই যুদ্ধজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনা। দেবী সুরাপান করে আরক্তনয়না। হেসে অস্পষ্ট বাক্যে অসুরকে বলছেন, ‘আমি পান করি, তুই গর্জন কর।’ দুর্গা শুধুই সংহারমূর্তি ধারণ করেননি। মদ্যপান, আরক্তলোচন, অস্পষ্ট স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কথার মোহিনী মূর্তিও ছিল।
সেই মোহিনী এক লাফে মহিষাসুরের উপরে চড়ে বসেছিলেন। তার গলায় পা দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন শূল। শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, ধূম্রলোচন — কোনও অসুরকে মারার সময়েই এ ভাবে সুরাপানে দেবীর কথা জড়িয়ে যায়নি। লাফ মেরে কারও শরীরে চড়ে বসেননি।
আদিবাসী জনজাতির উপকথায় এই মদ্যপানই হয়ে যেতে পারে হাঁড়িয়া খাওয়া। অসুরের শরীরে চড়ে বসা হয়ে উঠতে পারে প্রেম ও প্যাশনের আততি-ভরা রোমাঞ্চকর এক খুনের মুহূর্ত।
কিন্তু আদিবাসী জনজাতির ইতিহাস, পুরাণ রচনা করে না। তারা পরাজিত। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস লেখে। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, সবই বিজয়ীদের ব্যাখ্যা। আসিরিয়ার আসুরবানিপাল কেমন দেখতে ছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা শিলাপটে আজও তা দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে বিজয়ীরা মহিষ রাজার স্মৃতিটুকুও রাখেনি। এক সাঁওতাল শিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখেছিলাম, লাঠি হাতে পাগড়ি মাথায় এক রাজা। কাছে দুটো মোষ চড়ে বেড়াচ্ছে। বিজয়ীর জনসংস্কৃতি এই সব ছবির খবর রাখে না। কুমোরটুলিতে গড়া, ত্রিশূলবিদ্ধ পরাজিত ও রক্তাক্ত পুরুষই তাদের কাছে একমাত্র মহিষাসুর।
শাখুয়াপানি গ্রামে চমরু অসুর বলেন, ‘এত হইচই কেনে বলেন তো। সবাই জানে, আমরা আলাদা। আগে জমিদার দুগ্গাপুজোর সময় আমাদের জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, পাতা এনে দিতে বলত। আমরা সে সব দিয়ে, পুজো শুরুর আগেই চলে আসতাম। পূর্বপুরুষদের কাছে বলতাম, তাঁরা যেন বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন।’ ঝোবিপাটের অনিল অসুর বলছিলেন, তাঁর মা এক সপ্তমীর সন্ধ্যায় দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিলেন। চার দিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ, অনিলের মায়ের পরনে নতুন শাড়ি। তখনই অনিলের বাবা বলেছিলেন, ‘কোথায় যাও? যে আমাদের পূর্বপুরুষকে মেরে ফেলেছিল, তার পুজো দেখতে?’ অনিলের মা আর যাননি। ছেড়ে ফেলেছিলেন নতুন শাড়ি, বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঘরের দরজা-জানলাও।
অনিলরা অবশ্য এখন দুর্গাপুজোর সময় নিঃশব্দে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেন না। ইন্টারভিউ দেন, সগর্বে জানান তাঁদের রীতিনীতি ও সংস্কারের কথা। হাজার বছর পরে পরাজিতরাও প্রত্যাঘাত করে। জানিয়ে দেয়, বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদই সব নয়। কে বলতে পারে, কুমোরটুলি এক দিন ভিলেন মহিষাসুরের বদলে, মহিষ রাজাকে বেছে নেবে কি না? (মুল লেখাটি সামান্য সম্পাদনা করা হয়েছে।)

Thursday 11 October 2018

এশিয়া মহাদেশের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা।

Image may contain: 1 person, text
সে এক মেয়ে ছিল, যে ভারতে প্রথম গার্লস স্কুল তৈরি করেছিল। তাও আবার ছোট জাতের মেয়েদের জন্য, যাদের পড়াশোনার কথা কেউ ভাবতে পারত না।
আঠেরো বছরের হেড-দিদিমণি ঘর থেকে বেরনোর সময়ে ব্যাগে রাখত বাড়তি শাড়ি। রাস্তায় এত লোক কাদা ছুড়ত, যে ইস্কুলে গিয়েই শাড়ি বদলাতে হত।
তাতেও শিক্ষা হয়নি মেয়ের। গর্ভবতী হয়ে-পড়া ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবাদের ডেকে এনে ঠাঁই দিত ঘরে। যাদের কথা শুনলে আজও লোকে আঙুল দেয় কানে।
একশো কুড়ি বছর আগে মারা গিয়েছেন সাবিত্রীবাই ফুলে। এই মার্চেই। নারী দিবসের দু’দিন পরে, ১০ মার্চ তাঁর মৃত্যু দিন। মারা গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু যে বছর জন্মেছিলেন, সেই ১৮৯৭ সালে।
কিন্তু রোহিত ভেমুলার এই যুগে তাঁর মতো জ্যান্ত আর কে আছে? সনাতন হিন্দুত্বের যখন জয়জয়কার, ভ্যালেন্টাইন্স ডে শুনলে খেপে মারতে আসে লোক, দলিত লেখককে কুপিয়ে খুন করা হয়, তখন সাবিত্রীর জীবনকথা— এমনকী তার মৃত্যুর কথাও— চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জাতীয়তা মানে কী, দেশপ্রেম কাকে বলে। কাকে বলে নারী অধিকার, সমমর্যাদা। তাঁরই উদ্যোগে পুণে শহরে সব নাপিত হরতাল করে এক দিন। বিধবা হলেই মাথা কামাতে হবে মেয়েদের? মানব না।
সাবিত্রীবাইয়ের জীবন থেকে গোটা পাঁচেক সিরিয়াল, গোটা দুয়েক হিন্দি সিনেমা, আর কয়েক ডজন নাটক-উপন্যাস নামিয়ে ফেলা যায়।
ধরা যাক রাস্তায় হেনস্থার এপিসোডটা। শুধু কাদা নয়, পাথরও ছুড়ত লোকে। আটকাতে রাখা হল এক বডিগার্ড, বলবন্ত সখারাম কোলে। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, সাবিত্রীবাই বলতেন, ‘তোমাদের গোবর, পাথর— আমার কাছে ফুল।’
যখন শুরু এ গল্পের, কোম্পানির সেপাইরা বিদ্রোহ করেনি। কলকাতায় বেথুন সাহেবের ইস্কুল তৈরি হয়নি। জেলায় জেলায় বালিকা পাঠশালা বিদ্যাসাগরের মাথায় একটা আইডিয়া। সেই ১৮৪৮ সালে একটা একুশ বছরের ছেলে তার আঠেরো বছরের বউকে নিয়ে মেয়ে-ইস্কুল খুলে ফেলল পুণেতে।
ফল মিলল হাতে হাতে। বাবা বাড়ি থেকে বার করে দিলেন ছেলে-বউকে। জ্যোতিরাও ফুলে আর তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাই। ফুল থেকে ‘ফুলে’, মালির জাত। সোজা কথায়, দলিত। একে মালি হয়ে মাস্টারি, তা-ও দলিত আর মুসলিম মেয়েদের স্কুল?
টাকা-পয়সা জোগাড়ে বেরোলেন জ্যোতিরাও, দুই বন্ধুর তত্ত্বাবধানে চলল সাবিত্রীর তালিম। ফের ১৮৫১ সালে স্কুল খুলল। সাবিত্রী প্রধান শিক্ষিকা, স্কুলের প্রাণকেন্দ্র। বছর দুয়েক না যেতে ‘পুনে অবজার্ভার’ কাগজ লিখছে, ‘মেয়েদের ইস্কুলে ছাত্রীরা অনেক ভাল শিখছে সরকারি ইস্কুলের ছেলেদের চাইতে। সরকার কিছু করুন, নইলে মেয়েরা বেশি ভাল ফল করলে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যাবে।’
তত দিনে ঈশ্বরচন্দ্র বেথুন স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর নির্দেশে ছাত্রীদের গাড়ির পাশে লেখা হয়েছে মহানির্বাণতন্ত্রের বাণী, ‘কন্যারাও সমান যত্নে পালনীয়, শিক্ষণীয়।’ কিন্তু মেয়ে শিক্ষক তৈরির প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মেয়েরা বাড়ির বাইরে কাজ করবে, এটা মানার জন্য সমাজ তৈরি নয়, ছোটলাটকে চিঠিকে লিখেছিলেন। তিনি নিজেই কি রাজি ছিলেন? নিজের স্ত্রী, দুই কন্যাকে লেখাপড়া শেখাননি তিনি।
জ্যোতিরাও ঈশ্বরচন্দ্রের চাইতে সাত বছরের ছোট, সাবিত্রী এগারো বছর। তাঁদের কাজের গোড়া থেকেই ছাত্রী তৈরি আর শিক্ষিকা তৈরি চলেছে পাশাপাশি। বিদ্যাসাগর যখন অতি কষ্টে কায়স্থদের ঢোকাতে পারছেন সংস্কৃত কলেজে, সুবর্ণ বণিক ছাত্রকে ঢোকাতে না পেরে আক্ষেপ করছেন, তখন একেবারে ‘অস্পৃশ্য’ মাং, মাহার, মাতং পড়তে আসছে সাবিত্রীবাইয়ের নেটিভ ফিমেল স্কুলে।
আজকের ইতিহাস বইতে দলিত আন্দোলনের চ্যাপ্টারে সাধারণত লেখা হয় জ্যোতিরাও ফুলে-র কথা। সাবিত্রী তার ফুটনোট। অথচ আশ্চর্য, ব্রাহ্মণ বিধবাদের দুঃখ নিজের মধ্যে অনুভব করেছেন সাবিত্রী। সময়টা ১৮৬৩। কাশীবাই নামে এক ব্রাহ্মণ বিধবাকে গর্ভবতী করে কেটে পড়ে এক শাস্ত্রীজি। কাশীবাই জন্ম দিয়ে গলা কেটে মারে শিশুকে। ‘খুনি’ কাশীবাইকে ইংরেজ সরকার আন্দামানে পাঠায়। আহত ফুলে দম্পতি গোটা শহরে পোস্টার সাঁটেন, শিশুহত্যা না করে আমাদের আশ্রমে আসুন। পরের কুড়ি বছরে প্রায় ৩৫ জন ব্রাহ্মণ বিধবাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন সাবিত্রী।
মেয়েদের জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগর অনেক লড়াই করেছেন, কিন্তু ভালবেসেছেন কি? রামমোহনের তিন স্ত্রী ছিল, কারও সঙ্গেই মনের ঘনিষ্ঠতার কথা জানা যায় না। শোনা যায়, তাঁর দত্তক নেওয়া সন্তান রাজারাম নাকি মুসলিম উপপত্নীর গর্ভজাত। বিদ্যাসাগরের বিপুল কর্মকাণ্ডে স্ত্রী দয়াময়ী কই? অথচ একই প্রজন্মের মানুষ জ্যোতিরাও-এর মেয়েদের স্কুলে সাবিত্রী চালিকাশক্তি, তাঁর সত্যশোধক সমাজে সাবিত্রী ৯০ জন মেয়ে নিয়ে শামিল, সম্মেলনে তিনি সভানেত্রী। ১৮৬৮ সালে স্বামীকে সাবিত্রী চিঠি লিখছেন, ‘এক ঘটনা হয়ে গেল। এই গণেশ ছেলেটি ব্রাহ্মণ, মেয়েটি মাহার। মেয়েটি গর্ভবতী জেনে সবাই ওদের পিটিয়ে মারার চেষ্টায় ছিল। আইনের ভয় দেখিয়ে আমি অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছি। তোমার কাছে পাঠালাম।’ ওই যুগলের কী হয়েছিল, জানা যায় না। তবে এক বিধবার গর্ভজাত পুত্রকে দত্তক নেন ফুলে দম্পতি। সেই ছেলে যশোবন্তের বিয়ে সম্ভবত আধুনিক ভারতের প্রথম অসবর্ণ বিবাহ।
তবে তার চাইতেও যা চমকে দেয় তা হল, বিয়ের আগে পুত্রবধূ লক্ষ্মীকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন সাবিত্রী। যাতে ছেলে-বউ এ-ওর মন বুঝতে পারে। সিরিয়ালের শাশুড়িদের দেখলে মালুম হয়, আজও এমন মেয়েকে চিত্রনাট্যে ফিট করা সোজা হবে না। মঞ্চে নারীবাদী বিস্তর, সংসারে বিরল।
আশ্চর্য এই মহিলা প্রায় আড়ালে রয়ে গেলেন। দাবি উঠেছে, ৩ জানুয়ারি, তাঁর জন্মদিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ বলে পালন করা হোক। সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণণ বরেণ্য দর্শনবিদ, আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষার উৎকর্ষ তাঁকে দেখে শিখতে হয়। কিন্তু যে শিক্ষক সব শিশুকে সমান শিক্ষা না দেওয়ার অপরাধে গোটা দেশকে বেঞ্চে দাঁড় করাতে পারেন, প্রথম পাঠ নিতে হবে তাঁর থেকেই। ‘শিক্ষার অধিকার’ মানে কী, জানতে হলে সাবিত্রীর জীবনটা জানতে হবে। শেষ অবধি তাঁর জন্মদিনে তেমন কিছুই হয়নি, তবে গুগল তাঁকে নিয়ে ডুড্‌ল করেছিল সে দিন। তাঁর দুই বাহুর মধ্যে মেয়েরা, সবাইকে যেন তিনি টেনে নিচ্ছেন কাছে। গত তিন দশকে তাঁর উপর তেমন কোনও বইও লেখা হয়নি। পেশোয়া বাজিরাওকে ভালবাসার টানে বুন্দেলখন্ডের রাজকুমারী মস্তানির লড়াইটা নতুন করে চিনল সবাই। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে আনার লড়াইটা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে যে মরাঠি মেয়েটি লড়ে গেল সবার আগে, বিস্মৃতির বাঘ তাকে খেয়ে গিয়েছে।
বেঁচে থাকতে সম্মান কম পাননি সাবিত্রী। পণ্ডিতা রমাবাই, আনন্দীবেন জোশি, রমাবাই রণদে, সে কালের শিক্ষিতা মেয়েরা এসে দেখা করে গিয়েছেন। সাবিত্রী ছিলেন মাঝারি গড়নের, সুমুখশ্রী, শান্ত মানুষ। তাঁকে কেউ নাকি রাগতে দেখেনি। যা করার, হাসিমুখে করে গিয়েছেন।
জীবনের শেষ দিন অবধি ব্যতিক্রমী সাবিত্রী। প্লেগ তখন মহামারী। মায়ের কথায় যশোবন্ত সেনাবাহিনীতে ডাক্তারির চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পুণেতে প্লেগের ক্লিনিক খুলে বসলেন। সাবিত্রী
নিজে রোগীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। রোগ ছোঁয়াচে, তা জেনেও। শেষে একদিন পরিচিত
এক মাহার পরিবারের বালক সন্তানকে পিঠে করে নিয়ে এলেন ক্লিনিকে। ছোঁয়াচে রোগ বাসা বাঁধল তাঁরও শরীরে। তাতেই মারা গেলেন ১৮৯৭ সালে।
এত নির্ভয় কোনও মেয়ে হতে পারে, ভাবলেও ভয় করে।

মেরি কম বক্সিং-এ ৫ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন

Image may contain: 2 people, people smiling
বক্সিং-এ ৫ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক পদক বিজেতা এবং রাজ্যসভা সংসদ Ms. Mary Kom as Brand Ambassador of Tribes India”। মেরি কম পূর্ব ভারতের মনিপুর রাজ্যের আদিবাসী।

আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম দত্তক নিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।

No automatic alt text available.
আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম দত্তক নিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।
এক দিন বিশ্বভারতীর অংশ হবে চৌপাহাড়ি জঙ্গল সংলগ্ন তাঁদের গ্রামগুলিও। আশায় দিন গুনছিলেন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের রুবি হেমব্রম, জিতেন মাড্ডি, সুনীল বেসরা ও ছোট্টু মুর্মুরা। গত শনিবার ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তাঁদের স্বপ্ন সত্যি হল।
চলতি বছরের ২৫ মে (২০১৮) বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে আসে গ্রামীণ পুনর্গঠনে কবিগুরুর দর্শনের কথা। তার পরই বিশ্বভারতীর অধীনে থাকা ৫০টি গ্রাম নিয়ে কাজ করার যেমন প্রশংসা করেছিলেন, তেমনই প্রতিষ্ঠানের ১০০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিশ্বভারতীর অধীনে আরও গ্রাম এনে সংখ্যাটা ১০০ থেকে ২০০ করার আহ্বান জানান। তাতে প্রাণিত হয়ে আরও ৫০টি গ্রামকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ।
গত শনিবার ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ জীবনব্যাপী শিক্ষা ও সম্প্রসারণ বিভাগের উদ্যোগে রামনগরে হওয়া একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক ভাবে মোট ১০৬টি গ্রাম নিয়ে কাজ করা শুরু করল বিশ্বভারতী। কবিগুরু পল্লি-পুনর্গঠনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কুঠিবাড়িতে শুরু হয়েছিল ইনস্টিটিউট অফ রুরাল রিকনস্ট্রাকশনের কাজ। পরে তা নাম পায় শ্রীনিকেতন। শান্তিনিকেতন থেকে মাইল দুয়েক দূরে শ্রীনিকেতনেই প্রাণ পেতে থাকে কবিগুরুর গ্রামীণ ভাবনা। সেই সময় পার্শ্ববর্তী ৬টি গ্রামকে নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। ক্রমে সেই সংখ্যাটা হয়েছিল ৫০। জীবনব্যাপী শিক্ষা ও সম্প্রসারণ বিভাগ বর্তমানে বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লক ও ইলামবাজার ব্লকের ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মোট ৫০টি গ্রাম নিয়ে কাজ করছিল। এ বার সেই সংখ্যাটা বেড়ে ১০৬ হল।
গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে জীবনব্যাপী শিক্ষা ও সম্প্রসারণ বিভাগ রায়পুর, বিনুরিয়া, ইসলামপুর, পারুলডাঙা, বল্লভপুর, খোসকদমপুর, গোয়ালপাড়া সহ ৫০টি গ্রাম নিয়ে কাজ করছে। সার্বিক উন্নয়নের জন্য গঠন করা হয়েছে ৪০টি গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা, ১২টি মহিলা সমিতি, ৩৬টি গ্রামীণ পাঠাগার। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় আলোচনা সভা, উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মানুষদের সচেতন করার কাজ চলছে। সুবিধার জন্য কয়েকটি গ্রাম নিয়ে ক্লাস্টার অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। ইলামবাজার চৌপাহাড়ি জঙ্গল সংলগ্ন আদিবাসী গ্রামই রয়েছে প্রায় ১২টি। ধল্লা, রাঙাবাঁধ, বনশুলি, খয়েরডাঙা, আমখই, লক্ষ্মীপুর, পুরাণঢিল সবই আদিবাসী গ্রাম। গ্রামগুলিতে সার্বিক উন্নয়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। গত তিন বছর ধরে জঙ্গল সংলগ্ন আদিবাসী গ্রাম এবং লাভপুরের আদিবাসী গ্রামগুলিতে ডাইনি প্রথা নির্মূলেও কাজ করেছে বিশ্বভারতী। এ বার এই গ্রামগুলির দায়িত্ব নেওয়ার ফলে কাজ করা আরও সুবিধা হবে বলেই মনে করছেন কর্তৃপক্ষ।
এ দিন, রামনগর হুল মঞ্চে আদিবাসী সমাজে কুসংস্কার ও সামাজিক ব্যাধি এবং তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনাসভায় উঠে আসে শিশুশ্রমিক, নাবালিকা বিবাহ, ডাইনি প্রথা, ঝাড়ফুঁক প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধির কথা। 
ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন জানান, আগে থেকে যে সমস্ত গ্রামগুলি নিয়ে বিশ্বভারতী কাজ করে চলেছে সেগুলির মানসিক চেহারা বদলে গিয়েছে। নতুন গ্রামগুলিতেও তাই-ই হবে বলে আশাবাদী তিনি। ব্যাধি দূর করতে মহিলাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আটটি মহিলা দলের হাতে দু’টি করে ফুটবল তুলে দেওয়া হয়।
জীবনব্যাপী শিক্ষা ও সম্প্রসারণ বিভাগের প্রধান সুজিতকুমার পাল বলেন, ‘‘আমরা এই গ্রামগুলিতে আগেই ডাইনি প্রথা নির্মূলের উপরে কাজ করেছি। আপাতত সামাজিক সচেতনতা তৈরির উপরে কাজ হবে। ধীরে ধীরে গ্রামগুলির সার্বিক উন্নয়নের দিকে আমরা এগোব।’’

Wednesday 10 October 2018

লালু কয়েক লক্ষ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে লড়াই করে মেডিক্যালে স্থান দখল করেছে।

Image may contain: 2 people, people standing
অভিনন্দন লালু হেমব্রম
লালু কয়েক লক্ষ টাকার লটারি পেয়ে শিরোনামে আসেনি! 
বরং কয়েক লক্ষ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে লড়াই করে মেডিক্যালে স্থান দখল করেছে।
# আমাদের গর্ব পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনির #লালু_হেমব্রমের কথা বলছি.... জীবনে অনেক বাধা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে MBBS পাঠরত....অল্প বয়সেই পিতৃহারা হয়েও জীবন যুদ্ধের লড়াই থেকে পিছপা হয়নি.... বরং ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করে নতুন উদ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইটা লড়েছে... যখন খবর পাই মেদিনীপুর শহরের এক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান #মেদিনীপুর_স্যোসাল_ওয়েলফেয়ার_ফোরাম লালু হেমব্রমকে সংবর্ধিত করবে এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে, তখন আমরাও উনাদের আমন্ত্রণে #মেদিনীপুর_ছাত্রসমাজ ওখানে উপস্থিত থেকে লালুকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন জানাই এবং সেই সাথে আশীর্বাদ স্বরূপ কিছু পরিমাণ অর্থ লালুর হাতে তুলে দিই.... ধন্যবাদ জানাই ফোরামের সভাপতি সত্যব্রত রায়, সম্পাদক নিত্যানন্দ পন্ডা, অশোক চক্রবর্তী মহাশয় সহ সকল কর্মকর্তাদের, এই সুন্দর অনুষ্ঠানে সাক্ষী থাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য..... যদিও এই মানবিক সংগঠন ছাত্রসমাজকে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করে থাকে এবং অনেকগুলো কাজ আমরা একযোগে হাতে হাত ধরে করে থাকি।লালুর আগামী দিনের চলার পথ আরও সুন্দর হোক মঙ্গলময় ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।সর্বোপরি লালু অসহায় মানুষের প্রকৃত সেবা দেওয়ার মতো মানবিক ডাক্তার হয়ে ওঠ..... তোর চলার পথে আমাদের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা দুটোই সবসময় থাকবে.... 
(কৃষ্ণগোপালের ওয়াল থেকে)

ᱠᱚᱯᱷᱤ ᱟᱱᱟᱱ

ᱛᱟᱡᱽᱢᱚᱦᱚᱞ

ᱟᱠᱵᱚᱨ

WELCOME TO KARAM FESTIVAL 2018 6TH ANNIVERSARY

Image may contain: text

Tamil director to make biopic on Birsa Munda

Illustration: Deepak Harichandan

Gopi Nainar’s film on the tribal freedom fighter will be in Munda and other languages

In a novel pan-Indian effort, Tamil director Na. Gopi Nainar is chronicling the life of the iconic tribal leader and freedom fighter Birsa Munda in a film in the Munda language.

Isaignani Ilayaraja has been roped in to score the music for the film, which will include songs of the Munda people and songs composed to propagate the freedom struggle during Bisra Munda’s time.

The director said he was introduced to the Munda tribe and Birsa Munda, who died at the age of 25 in prison under mysterious circumstances, through the writings of Dr. Ambedkar.

“Later I read about him in Bengali writer Mahasweta Devi’s novel Aranyer Adhikar (Right to the Forest) and his biography presented by a Communist friend of mine,” said Mr. Nainar.

Current resonance

Asked why he had decided to make a film about a freedom fighter in a distant land, Mr Nainar said a theme on land rights led him towards Birsa Munda.

“Many tribal leaders fight for the community’s right over land and recognition for their community. Bisra Munda viewed freedom for the nation as part of the right over land for housing and agriculture. The fight against the landlords also included the British Raj,” he said.

“It is a feature film without glossing over the realities of the story,” said Mr. Nainar, whose 2017 commercial film Aram , portraying the water crisis, with Nayantara in the lead role, was a box office hit.

Though he has zeroed in on an actor to play Birsa, Mr Nainar said he was open to the idea of a member of the Munda tribe taking on the role.

Unlikely hero

“He is not a typical film hero — six feet tall and toned physique. Birsa was a tribal leader who was less than five feet tall,” Mr. Nainar said, adding that the film will be also made in Tamil, Hindi and other languages.

Though Birsa converted to Christianity, he later launched his own sect and posed a challenge to missionaries. His slogan, “Let the kingdom of the queen be ended and our kingdom be established,” is still remembered in tribal areas of Odisha, Bihar, West Bengal, and Madhya Pradesh.

His resistance resulted in the British enacting a law to protect the land rights of tribals.

Mr. Nainar already started the shooting and soon his unit would visit Jharkhand. “We will capture the world of tribals, their culture and language. I hope to complete the exercise in 45 days,” he said.

Monday 8 October 2018

মহান শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবি পদ্মশ্রী ডঃ রামদয়াল মুণ্ডা

ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ডঃ রামদয়াল মুণ্ডাকে বেশীরভাগ ভারতবাসী রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য (এমপি) হিসাবেই জানেন। কিন্তু তাঁর ব্যাপক এবং বিশাল কর্মকান্ড তাঁকে একজন মানবদরদী ব্যাক্তি, পিছিয়ে পড়া-সমাজে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অৰ্থনৈতিক উন্নয়নের একজন ব্যস্ততম সৈনিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তিনি আদিবাসী মুণ্ডা সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁর কর্ম সংস্কৃতির দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের সম্মান উচু করে গিয়েছেন। সারা জীবন তিনি আদিবাসী তথা সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকদের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছিল মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে।
রামদয়াল মুণ্ডা রাঁচীর নিকট অবস্থিত সিউড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ২৩শে আগষ্ট ১৯৩৯ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন গন্দর্ভ সিং মুণ্ডা, মায়ের নাম লোকমা মুন্ডা। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন তাদের গ্রামের নিকট অমলেশা নামক জায়গায় লুথারেন মিশন স্কুলে। সেই স্কুলে বিদেশ থেকে অতিথিরা আসতেন। আর এভাবে বহির্জগতের সংগে প্রথম থেকেই তাঁর পরিচয় শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই আদিবাসীদের গান, নাচ, বাঁশী বাজানো, মাদল বাজানোর প্রতি
তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল। কিন্তু তাঁর পিতা এসব জিনিস পছন্দ করতেন না। তাঁর ঠাকুর্দা চামু সিং মুন্ডা তাঁকে বাঁশী বাজানো, মাদল বাজানো এবং নাচে গানে প্রশিক্ষিত করেন প্রতিদিন নিকটবর্তী জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে। মাধ্যমিক স্কুল মহকুমার শহর খুঁটিতে পড়াশোনা করেন। সেটা তাঁর গ্রাম থেকে ৪০ কিমি দূরে। বিরসা মুন্ডার আন্দোলনস্থল হওয়ার জন্য বিদেশ থেকে বহু মতবিদ আসতেন সেখানে । ডঃ মুন্ডা তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তাদের গাইড হিসাবে কাজ করতেন। 
উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে নৃতত্ত্ব নিয়ে এম.এ. পাশ করেন ১৯৬৩ সালে। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্য চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে (আমেরিকা) সুযোগ পান। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সহকারী গবেষক হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষা (অস্ট্রিক সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডারি) এবং সভ্যতা নিয়ে গবেষণা করেন এবং ১৯৭০ সালে তিনি সেখান থেকে পিএইচডি পান। তিনি সেই বছরেই আমেরিকার মিনোসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগপত্র পান। ১৯৮৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন আর রাচিী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সহ উপাচার্য আর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। তিনি অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালে।
মিনোসোটা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঁচিী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩), নিউ ইয়র্কের সিনাকুজ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৬) এবং টোকিও ইউনিভাসিটি অফ ফরেন স্টাডিজ এ শিক্ষা দান করেন। কর্মসূত্রে আমেরিকাতে থাকাকালীন তিনি সাংস্কৃতিক দল তৈরী করেন ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার করনে। ।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ডঃ রামদয়াল মুভার অবদানের জন্য ভারত সরকার ২০০৭ সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার’ দান করেন। এর কয়েক বছর বাদে ডঃ মুন্ডাকে ‘পদ্মশ্ৰী' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই উপাধি দেশের জনসাধারণকে দেওয়া চতুর্থতম উচ্চ উপাধি যা ডঃ মুন্ডাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে শ্রীমতি প্রতিভা পাতিল দেন।
তাঁর দীর্ঘজীবনে ডঃ মুন্ডা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জড়িত থেকে আদিবাসী তথা অন্যান্য দেশবাসীর জন্য অনেক কাজ করেছেন। যে সব প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন সেগুলি হল 
(১) কমিটি অল ঝাড়খন্ড ম্যাটারস (১৯৯৮-১৯৯৫)
(২) এনথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৯৮৯ -১৯৯৫),
৩) ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসিরিভিউ কমিটি (১৯৯০)
(৪) জহরলাল ইউনিভার্সিটি পরিচালন সমিতি (১৯৯০-১৯৯৫), 
(৫) নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি (১৯৯৩-৯৬) ষ্টিয়ারিং প্রপ, 
(৬) প্ল্যানিং কমিশন (১৯১৬-২০০০) 
(৭) এক্সপার্ট কমিটি ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (১৯৯৭-২০০০)
(৮) ন্যাশনাল এডভাইজারী কমিটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (১৯৯৭-২০০০) 
(৯)স্টাডিং কমিটি হিউম্যান রাইট
এডুকেশন - ইউ.জি.সি (১৯৯৮-২০০১) 
(১০) ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রমোশন অফ সোসাল এন্ড ইকোনমিক ওয়েলফেয়ার (১৯৯৮-২০০১)
(১১) এক্সপার্ট কমিটি, সাহিত্য একাডেমি (১৯৯৯) (১২)ন্যাসানাল কমিটি ফর টিচার্স এডুকেশন (২০০০-২০০৩) 
(১৩) চেয়ারম্যান হিসাবে ওয়ার্কিং এপ অন এমপাওয়ারমেন্ট অফ..টি. প্ল্যানিং কমিশন (২০০০-২০০৫) 
(১৪) টেকনিক্যাল সাপোর্ট গ্রুপ ফর ফরমুলেশন অফ রুলস টু অপারেশনালাইজ দি.এসটি আড আদার ফরেষ্ট ডুয়েলার্স এক্ট (২০০৬-২০০৭) 
(১৫) কমিটি টু সেট আপ সেন্ট্রাল ট্রাইবাল ইউনিভার্সিটি (২০০৭)
(১৬) প্রেসিডেন্ট, আদিম জাতি সেবামণ্ডল (১৯৯০ থেকে) |
(১৭) প্রেসিডেন্ট, বিনরাই ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড আ্যকসন (১৯৯৭ থেকে) 
(১৮) প্রেসিডেন্ট, অল ইন্ডিয়া লিটারীর ফোরাম (২০০৫)
(১৯) সেক্রেটারী-ভারতীয় সাহিত্য বিকাশ ন্যাস (১৯৯৮ থেকে)।
সার্দরি ভাষায় ডঃ রামদয়াল মুণ্ডার স্লোগান ছিল, “যেহে নাচী সেহে বাঁচী‍‌" (যে নাচবে সে বাঁচবে) নৃত্যই তাঁর কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র। নাচের দ্বারাই তিনি জীবনকে উপভোগ করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে রাশিয়াতে যে সাংস্কৃতিক দল পাঠানো হয়েছিল তিনি তার নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৮৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, ফিলিপাইনসের ম্যানিলাতে, ১৯৮৯ সালে চীন, জাপান ইত্যাদি দেশে তাঁর সাংস্কৃতিক দল নিয়ে যান। ঝাড়খণ্ডের প্রতিটি গ্রামে যাতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তথা “আখড়া” তৈরী হয় তিনি তার জন্য অনেক ভাবে চেষ্টা করেন।
এছাড়া ডঃ মুন্ডা ইন্ডিয়ান কনফেডারেশন অফ ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পিওপলস্ (Confederation of Indigineous & Tribal People) এর একজন প্রতিষ্ঠাতা। জীবিত থাকা অবধি ইনি এই সংস্থার চিফ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ভারতীয় আদিবাসীদের প্রতিনিধত্ব করার জন্য জেনিভা(১৯৮৭),কেপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক (১৯৯৭), বার্লিন ভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষের আদিবাসীদের নিয়ে ওয়ার্ড সোসাল ফোরাম মুম্বই (২০০৪) এবং নতুন দিল্লী(২০০৭), তিনি তাঁর সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান করেন। ১৯৯৮ সালে নাগপুর ইন্টারন্যাশনাল এলিয়েন্স ফর ইন্ডিজেনাস পিওপলস্ অফ ট্রপিকাল ফরেষ্ট এর অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। ইন্দোরে ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান ইন্ডিজেনাস। পিওপলস্ কনফারেন্স অন ইউনাটেড নেশানস্ পারমানেন্ট ফোরাম অন ইন্ডিজেনাস পিওপলস্। এই অনুষ্ঠানে তিনি যোগদান করেন। লেখনীতেও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনি সর্বমোট ২৮টি বই লিখেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি অনুবাদ সাহিত্য। তাঁর লেখা ‘আদিধরম”-ভারতীয় আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস বহুল প্রচারিত হয়। উল্লেখ্য, তিনি ঝাড়খণ্ড পিওপলস পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনে তাঁর বিশাল অবদান ছিল।
৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১১ তাঁর নশ্বর দেহ পৃথিবী ছেড়ে গেলেও ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্বের আদিবাসীদের অন্তরের অন্তঃস্থলে দিশারী হয়ে যুগ যুগ ধরে ধ্রুবতারার মতো অম্লান হয়ে থাকবেন।

সৌজন্যে- সুবল চন্দ্র সরদার(সম্পাদক)
সুন্দরবন আদিবাসী জাগরণ সমিতি

সংরক্ষণ| কিছু কথা|

Image may contain: text
সংরক্ষণ নিয়ে সাধারণত যে আলোচনা হয়, সেটা Scheduled Cast (SC), Scheduled Tribe (ST) দের সংরক্ষণ নিয়ে। তারপরে আসে OBC দের সংরক্ষণ নিয়ে। এই সংরক্ষণ তিন প্রকার । (১) শিক্ষায় সংরক্ষণ (২) চাকরীতে সংরক্ষণ এবং (৩) নির্বাচনে সংরক্ষণ|
Scheduled Cast (SC), Scheduled Tribe (ST) এবং Other Backward class (OBC)| সংবিধানে SC দের সংরক্ষণ 15.% ST দের 7.50% এদের জন সংখ্যা হিসাবে এই সংরক্ষণ নির্ধারিত হয়েছিল। পরে OBC দের জনসংখ্যা 52% হওয়া সত্বেও 27% সংরক্ষণ কেন্দ্রীয় সরকারী হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে । রাজ্য সরকারী হিসাবে এই % আরো কম। এক এক রাজ্যে একক রকম । এই তিন বর্ণের মোট সংরক্ষণ 49.5%. এদের মধ্যে ধর্ম পরিবর্তিদের অর্থাৎ যারা এই তিন বর্গ থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে তাদের জনসংখ্যা 10.5% মত । মোট জনসংখ্যা হচ্ছে (৭.৫+১৫+৫২+১০.৫) 85%| এই 85% জনগণের অধিকার 50% সংরক্ষণে। যদিও সংবিধানে এই কথা উল্যেখ নেই যে সংরক্ষণ 50% এর উর্ধে হতে পারবে না । দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে 69% সংরক্ষণ আছে। আর সেখানকার প্রগতি ভারতবর্ষের অন্য যেকোন রাজ্যের থেকে অনেক বেশী ।
যে কথা বলছিলাম- 85% ভারতের জনসংখ্যার জন্য সংরক্ষণ 50% আর বাকি 15% লোকের জন্য অলিখিত সংরক্ষণ 50%| এর পরে আরো আছেন| 85% এর জন্য যে 50% সংরক্ষণ নির্ধারিত , তারা পায় বা পেয়ে থাকে বা ভোগ করে এই 50% এর অর্ধেকের ও কম । যেটা কম, সেটাও ভোগ করে ঐ 15% লোকেরা। এই 15% লোক কারা ? এরা ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্র এবং বৈশ্য। যাদের জনসংখ্যা যথাক্রমে 3.5%, 4.50%, 7% (এই % প্রায় এরকম )। এবার দেখুন এই তিন শ্রেণির লোকেরা 15% হয়েও 50% এর অধিক সুবিধা ভোগ করছে । কিন্তু এদের এতেও শান্তি নেই, তাই প্রতিনিয়ত SC, ST, OBCদের প্রতি বিষ নিক্ষেপ করে চলেছে । তাদের কথা হচ্ছে সংরক্ষণের জন্য দেশ পিছিয়ে পড়ছে । আপনারা একটু ভাবুন তো সত্যি সত্যি দেশ কাদের জন্য পিছিয়ে পড়ছে ? সেটা আপনারা কখনও ভাববেন না। প্রকৃত পক্ষে কারা সংরক্ষণের সিংহ ভাগ কারা ভোগ করছে দেখুন এই লিংকে।http://www.epaper.eisamay.com/Details.aspx…
এই পিছিয়া পড়া শ্রেণির লোকদের তো মানুষ বলে মনে করা হয় না। তাইতো তাদের SC- 1500, ST -700, OBC- 4743 জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে| জাতি হয় পশুদের মধ্যে। মনুবাদীরা এই SC, ST, OBC দের পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছেন। তথাকথিত স্বাধীনতার পর শাসন ভার কাদের হাতে চলছে ? প্রশাসনে কয়জন SC, ST, OBC আছে ? তবুও যতো দোষ নন্দ ঘোষ ? কথায় কথায় বলা হয় সংরক্ষণ আর্থিকতার উপর হওয়া দরকার । কিন্তু সংবিধানে সংরক্ষন তো আর্থিকতার উপর ভিত্তিকরে নির্ধারিত হয়নি। সংরক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে সামাজিক বৈষম্যের আধারে। আর সেই বৈষম্য করেন উচ্চবর্ণ মনুবাদীরা| কিন্তু সেকথা কেউ মনের ভুলেও উচ্চারণ করেন না কেন ?
একবার দেখে নেওয়া যাক এই সংরক্ষণের আধার কি ? তার আগে দেখি কাদের SC বলা হয়।
বহু শিক্ষিত লোক আছেন, যাঁরা Scheduled Caste কথাটার মর্মই বোঝেন না, এমনকি যারা চাকরিজীবি তারাও এর প্রকৃত অর্থ জানেন না। SC নামে কোন জাতি নেই। কতকগুলি জাতির সমষ্টি হচ্ছে SC . S-Scheduled, যার অর্থ অনুসূচী ।এখানে ‘অনু’ মানে ক্রমাঙ্ক এবং ‘সূচী’ মানে তালিকা। অর্থাৎ সূচী বা ক্রমবদ্ধ অর্থাৎ ধারাবাহিক তালিকাভুক্ত জাতি ।
কোন জাতিকে SC -এর তালিকাভুক্ত করার জন্যে তিনটি শর্ত আছে ।
(১) শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসরতা, (২) সামাজিকভাবে অনগ্রসরতা, ও (৩) এদের সঙ্গে অস্পৃশ্যতামূলক আচরণ ।
ST- দের জন্যেও এরূপ তিনটি শর্ত আছে । (১) শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসরতা, (২) সামাজিকভাবে অনগ্রসরতা, ও (৩) যাদের মধ্যে আদিম জীবন-যাত্রার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ।
আর OBC -দের ক্ষেত্রেও তিনটি শর্ত আছে । (১) শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসরতা, (২) সামাজিকভাবে অনগ্রসরতা, ও (৩)SC/ST নয়, অথচ অনগ্রসর ।
সংবিধানে যে তিন প্রকার মূল সংরক্ষণের উল্লেখ আছে , সেখান শিক্ষা ও চাকরির সংরক্ষণের কোন নির্ধারিত সময় সীমার উল্লেখ নেই । আর নির্বাচনে সংরক্ষণ ছিল দশ বছরের জন্য। কিন্তু প্রতি দশ বছর পরে পরবর্তি দশ বছরের জন্য নির্বাচনের সংরক্ষণ কে বাড়িয়ে দেওয়া হয় । কেন ? এই দশ বছরের জন্য বাড়ানোর জন্য কি কোন SC, ST রা কোন প্রকার আন্দোলন করেছে ? তবে কেন ? আর কেন বাড়াতে হবে তার জন্য সংসদে কি কোন চর্চা হয় ? কেন হয় না ? কারণ চর্চা হলে দেখা যেত নির্বাচনের সংরক্ষণের ফলে SC, ST রা কোন প্রকার উপকার পাচ্ছে না। সেটা পাচ্ছে বাকি শ্রেণির লোকেরা। SC, STদের মধ্যে থেকে যারা নির্বাচনে জয়ী হন , তারা পার্টির প্রতিনিধি রূপে কাজ করনে। তাঁর সমাজের নয়। যদি কেউ ভুল করে ও তাঁর সমাজের সমাজের কথা উল্লেখ করেন তবে তাঁকে জাত-পাত, সাম্প্রদায়িক বলে 'কুচে' মাছের চাল ছাড়ানোর মতো ছাল ছাড়ানো হয় মিডিয়ার মাধ্যমে। ফলে এরাঁ মনের ভুলে ও তাঁর সমাজের নাম নিতে সাহস পান না। গোলামিতে আনন্দ উপভোগ করে। তাই যে নির্বাচনে সংরক্ষণের বৃদ্ধি এটা উচ্চ শ্রেণির সুবিধার জন্যই। এখানে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে , যখন এই নির্বাচনের সংরক্ষণ পরবর্তি দশ বছরের জন্য বাড়ানো হয়, তখন মিডিয়া প্রচার করে SC, ST দের জন্য শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রের সংরক্ষণ দশ বছরের জন্য বাড়ানো হোল। এটা শুনে SC, ST দের বাকিরা গালি দিতে শুরু করে। যে গালি দেওয়ানোর কাজ ইচ্ছা করে করানো হয়। কারণ যাকে নীচ্‌ করে রাখা হয় তাকে গালি দিতে নীচ্‌ করে রাখার লোকদের মজা হয় । তাহলে এবার বলুন তো কে প্রকৃত সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করছে ? এই 85% লোকেরা 50% নিয়ে, নাকি 15% লোকেরা 50% নিয়ে ?
(মূল লেখাটি লিখেছন জগদীশচন্দ্র রায়, কিছু অংশ সম্পাদনা করা হয়েছে|)

Wednesday 3 October 2018

আদিবাসী বীরসম্রাট হুদুড়দুর্গার কাহিনী

Image may contain: 1 person

আদিবাসী বীরসম্রাট হুদুড়দুর্গার কাহিনী🍁
- - - দুর্গা সাঁওতাল ভাষায় পুংলিঙ্গ। এর স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি দূর্গী। সাঁওতালী লোকসাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে যে তাঁদের রাজা দুর্গার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের মত। ঝড়ের মত(প্রচন্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস বা ঝড়কে সাঁওতাল ভাষায় হুদুড় বলে)তাঁর গতি। তিনি ছিলেন পরাক্রান্ত বীর। আর্য সেনাপতি ইন্দ্র চাইচম্পাগড় আক্রমণ করে হুদূর দুর্গার হাতে পর্যুদস্ত হয়। পরপর সাতবার আক্রমণ করে পরাজিত হওয়ার পরে ইন্দ্র বুঝতে পারেন যে সরাসরি যুদ্ধে হুদুড়দুর্গাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই ছলনা এবং কৌশলের আশ্রয় নেন ইন্দ্র। হুদুড়ের রণকৌশলের মধ্যে কোন দুর্বলতা আছে কিনা এই খোঁজ শুরু করেন ইন্দ্র। ইন্দ্র জানতে পারেন যে অসুর নিয়ম অনুসারে এ দেশের রাজারা আশ্রিতের সাথে, শিশুর সাথে, দিবাবসানে, রাত্রে এবং নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। সুযোগ পেয়ে যান ইন্দ্র। তিনি লাবণ্যময়ী বারাঙ্গনা “দেবী”কে উপঢৌকন হিসেবে হুদূরদুর্গার কাছে প্রেরণ করেন। এক মহিষী থাকতে দ্বিতীয় নারীকে গ্রহণ করা যায় না এই অসুরনীতি মেনে দেবীকে প্রত্যাখ্যান করেন হুদূরদুর্গা। ইন্দ্র এবার নিজেই সন্ধির প্রস্তাব দেন। ঠিক হয় বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাঁরা বৈরিতা দূর করবেন। বিশ্বাস অর্জনের জন্য দেবীর সাথে হুদুড়দুর্গার বিয়ের প্রস্তাব দেন ইন্দ্র। হুদুড়দুর্গা আবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইন্দ্র জানান যে হুদুড়দুর্গা দেবীকে প্রত্যাখ্যান করলে লোকে তাঁর পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। উপায়ান্তর না ভেবে হুদূড়দুর্গা দেবীকে বিয়ে করতে রাজি হন।
ইন্দ্রের আসল উদ্দেশ্য ছিল দেবীর মাধ্যমে হুদুড়দুর্গার দুর্বল মুহূর্তগুলির খোঁজ নেওয়া এবং সেই সুযোগে তাকে হত্যা করা। দেবীর মাধ্যমেই ইন্দ্র জানতে পারেন যে একমাত্র রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে হুদুড়দুর্গা শস্ত্র খুলে রাখেন এবং তার দুর্ধর্ষ রক্ষীরা কাছে থাকে না। বিয়ে করার অষ্টম দিনে হুদূড়দুর্গাকে হত্যা করার কৌশল ঠিক করে নিলেন ইন্দ্র। তিনি দেবীকে জানালেন যে নবমীর রাতেই হুদূড়কে হত্যা করতে হবে। তাকে কামাসক্ত করে সুরাসক্ত করে মহাঘোরের মধ্যেই হত্যা করতে হবে। আদিবাসীদের বিশ্বাস নবমীর রাতেই দেবী নিজে আকন্ঠ সুরাপান করে এবং হুদুড়দুর্গাকে সুরাসক্ত অচৈতন্য করে তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেয় এবং পরেরদিন ভোর রাতে তার দেহকে ইন্দ্রের শিবিরে নিয়ে আসে। হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করার ফলে তার নাম হয় “দেবীদুর্গা”
#পারস্যের বারাঙ্গনা দেবী
দুর্গা #কে?
এই নিয়ে লোকসাহিত্যে নানা কাহিনী রয়েছে। একটি কাহিনীতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্র মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যের বিখ্যাত বারাঙ্গনা অ্যানার সাহায্য গ্রহণ করেন। উল্লেখ থাকে যে, এই অ্যানা "কাম ও যুদ্ধের দেবী"। আবেস্তা গ্রন্থে এই "দেবাস"দের শয়তানের অংশে জাত বলা হয়েছে। লোককথায় বলা হয়েছে যে, বারাঙ্গনা অ্যানা মহিষাসুরকে কামাসক্ত করে অচৈতন্য অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। তাছাড়া দুর্গা প্রতিমার পরিকল্পনায়ও হুবহু উঠে এসেছে অ্যানার প্রতিচ্ছায়া। দুর্গার সিংহবাহিনী রূপ, হাতের আয়ুধ সব কিছুই অ্যানার প্রতিরূপ। গবেষকেরা এইখানেই দেবাসুরের দ্বন্দ্বের মধ্যে আর্য এবং অনার্যের একটি চিরায়ত লড়াইয়ের সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন।
আর একটি উপকথায় পাওয়া যায় এই নারী ছিলেন ইন্দ্রের নিজের বোন দেবী। অন্যদিকে ভীল আদিবাসীরা দাবী করেন দুর্গা তাদের মেয়ে। দেবতারা তাকে শিবিরে নিয়ে গিয়ে মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। দেবীর আর এক নাম চণ্ডী। হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দাবী চণ্ডী তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাকে দিয়ে তাঁদেরই রাজাকে হত্যা করে। এখনো হাঁড়ি সম্প্রদায়ের চণ্ডী পূজায় কোন ব্রাহ্মণ ব্যবহার করা হয় না।
সাঁওতালরা দাঁশায় গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন যে হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে ইন্দ্র চাইচম্পাগড় বা হড়প্পা থেকে আদিবাসীদের বিতাড়িত করেন। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে নারীর ছদ্মবেশ ধারন করে “ইয়ায় নায়ে দিশম চাম্পা” বা সপ্ত নদীর দেশ হড়প্পা থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশ হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আজও তাঁরা বুক চাপড়ে ও হায়রে-ও হায়রে আওয়াজ করে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। দেবী দূর্গার হাতে হুদুরদুর্গা বা মহিষাসুরের হত্যার কাহিনী এভাবেই লোকায়ত হয়ে আছে আদিবাসীদের মধ্যে। আদিবাসী সত্তায় রাজত্ব হারানোর স্মৃতি এখনও সমান ভাবেই বর্তমান।
#পৌরাণিক কাহিনীতে মহিষাসুরঃ
আদিবাসীদের এই লোকসাহিত্যের অনেকটাই সমর্থন পাওয়া যায় নানা পুরাণ কাহিনীতে। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দোর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা”। অর্থাৎ দুর্গা নামক অসুরকে বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা হলেন।
দেবীপুরানে যে ঘোড়াসুরের বর্ণনা পাওয়া যায় তা হুদুড়দুর্গাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। 'সার্বনি' নামে অষ্টম মনুর মন্বন্তরের সময় যখন পুরন্দর দেবতাদের ইন্দ্র হয়েছিলেন (মার্কন্ডেয় পুরান 80 অঃ) সেই সময় রম্ভাসুরের পুত্র ' ঘোরাসুর' কুশদীপের অধিপতি ছিলেন। সেই ঘোরাসুরই মহিষাসুর নামে খ্যাত (দেবীপুরান- 1ম অঃ)। তিনি নিজে বাহুবলে জম্বুদ্বীপ, ক্রোঞ্চদ্বীপ, শাল্মদ্বীপ, পুস্করদ্বীপ, মানসদ্বীপ (স্বর্গ) ও নাগরাজ (পাতাল) জয় করে সপ্তদীপ ও সপ্তসমুদ্রের অধিপতি ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বলবান, বীর্যবান, বুদ্ধিমান, ও সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শি তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ন, সংযমী, বিলাসহীন, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতাবাদের আদর্শে প্রজাহিতৈষী। প্রজাগন শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বুকের মধ্যে খোদাই করে রাখত (দেবি পুরান -2 ও 16 তম অঃ)। পরস্ত্রী কে তিনি সর্বদা কন্যা ও মাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন (দেবিপুরান ষোড়ষ অধ্যায় শ্লোক নং 2-12) । তার মতো সর্বগুন সম্পন্ন মহান রাজা মহাভারত, রামায়ন এমনকি অনান্য পুরাণ কাহিনীগুলিতেও দ্বিতীয় কোনো রাজার পরিচয় পাওয়া যায় নি। কেবলাত্র রাজা হরিশচন্দ্রের মধ্যে কিঞ্চিৎ এই গুন থাকলেও হরিশচন্দ্রের তুলনায় তিনি বহুগুনে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
কোন সর্বগুণ সম্পন্না, কল্যাণময়ী নারীকে যেমন মহিষী বা মহিয়সী উপাধী দেওয়া হয় তেমনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে ঘোড়াসুরকে মহিষ , মহিয়ষ তথা (মহিষ+ অসুর ) মহিষাসুর উপাধি তে ভূষিত করা হয়েছিল। পরবর্তী কালের পুরাণগুলিতে বিশেষ করে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং ইদানীং কালের মহিষাসুর মর্দিনীতে মহিষাসুরকে মহিষের গর্ভজাত অথবা মহিষেররূপী এক মায়াবী এবং দুরাচারী অসুর হিসেবে দেখানো হয়। মূলত দুর্গা শক্তির নামে এক ব্রাহ্মন্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর জন্যই জনকল্যাণকারী, মঙ্গলময় আদিকৌম সংস্কৃতির মহান রাজা হুদুড় দুর্গা, ঘোড়াসুর বা মহিষাসুরকে 'অশুভ শক্তি'র প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শুভ এবং অশুভের #দ্বন্দ্ব ?
পণ্ডিতেরা বলছেন, অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশ নাকি দুর্গা পূজার অন্যতম অভিধা। কিন্তু এই ধাঁধার যথার্থ উত্তর খোঁজা প্রয়োজন বলে মনে করি। মনে করি যে আমাদের খুঁজে দেখা উচিৎ বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে কারা এই অশুভ শক্তির প্রতীক! কাদের দুর্দম্য, দুর্বিনীত আচরণের জন্য সাম্যবাদের এই মহান ভূমি কলুষিত হয়েছে বার বার? কারাই বা নারীকে ক্লেদাক্ত পঙ্কে নিক্ষিপ্ত করেছে। কারা নিমজ্জিত হয়েছে লুন্ঠন, ধর্ষণ ও জিঘাংসায়? কারা পূজার অছিলায় দুর্গা শক্তির নামে সমগ্র নারীসমাজকে গণিকার পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে? কারা এখনো পর্যন্ত নারীকে নরকের দ্বার মনে করে? কারাই বা শুধুমাত্র পুত্র কামনার্থে নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে? কারাইবা নারীকে বহুগামিতা ও বহুবিবাহে প্রলুব্ধ করে?
এই সমস্ত কাজ যদি সমাজ বিকাশে অকল্যাণকারী হয় এবং এদেরকেই যদি অশুভ শক্তির ধারক বাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়; তবে নিশ্চিত ভবেই ভারতের ব্রাহ্মন্যবাদ এই অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মহিষাসুর স্মরণ সভা। রাজ্যের প্রতিটি আদিবাসী গ্রামে পূর্ণ উদ্যমে দাঁশাই পালন করার জন্য প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে মূলনিবাসী-বহুজন সমাজ। সমগ্র রাজ্যের অনুষ্ঠানগুলিকে একসূত্রে গাঁথার জন্য গঠিত হয়েছে “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অসুর স্মরণসভা কমিটি”। এই কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, অসুর সংস্কৃতির শিকড়ের অণুসন্ধানই তাদের মূল উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদীদের মদতে দুর্গাপূজার অছিলায় যে সাম্রাজ্যবাদী, ভোগবাদী এবং আগ্রাসী শক্তি ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাতে বহুজন সংস্কৃতিতে নেমে এসেছে এক অস্তিত্বের সংকট। মহিষাসুর স্মরণ সভা সেই স্বাধিকার এবং শিকড়ের সন্ধানের এক সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই জাগরণ ভাবি কালের জন্য এক নব নির্মাণের ইঙ্গিত বহন করছে।
“দাঁশায়” আদিবাসীদের একটি শোকপালনের ব্রত। পাঁচদিন ধরে চলে এই শোক পালন। এই শোক পালন হয় নাচ, গান এবং ভিক্ষার মাধ্যমে। ভিক্ষা বৃত্তি সাঁওতাল সমাজে এক সামাজিক অপরাধ হলেও দাঁশায়ের দিনগুলিতে তাঁরা প্রতীকী ভিক্ষা করে। বুক চাপড়ে ও হায়রে, ও হায়রে ধ্বনি তুলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ করে। এই নাচকে বলা হয় “দাঁড়ান ভুয়াং” নাচ। লাউয়ের শুকনো বসের উপর ধনুকের মত ভুয়াং বাদ্যযন্ত্রতে টঙ্কার তুলে এই আর্তনাদ আসলে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া রাজার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরা বিশ্বাস করে “দেবী” নামে কোন এক গৌরবর্ণা নারী তাঁদের রাজাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে গোপন ডেরায় অথবা তাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেছে। এই দাঁশায় নাচের সমস্ত পুরুষেরা নারীর ছদ্মবেশে সজ্জিত হয়ে নেয়। পরনে শাড়ি, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করেন তাঁরা। শোনা যায় তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাজা হুদুরদুর্গা বা ঘোড়াসুরকে সব সময় ঘিরে থাকত সাত জন বীর যোদ্ধা। এই যোদ্ধারাই নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে তাদের রাজাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। হাতের শস্ত্রগুলিকে বাদ্যযন্ত্রের আদল দেওয়া হয়। যাতে সন্ধিক্ষনে যুদ্ধ বিজয়ে সেগুলো কাজে লাগে। “হায়রে ও হায়রে” ধ্বনি তুলে তাঁরা টিকটিকি, মাকড়সা গাছপালা, পশুপাখিদের তাঁদের রাজাকে দেখেছে কি না প্রশ্ন করে। সাংকেতিক ভাষায় প্রশ্ন করে এই ভুয়াং এর জন্ম কেমন করে হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই প্রশ্নের উত্তর কেবল হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরই দিতে পারেন। গানের সুরে তাঁরা প্রশ্ন করেনঃ
"অকারে দ ভুয়াং এম জানামলেনা রে? অকারে দ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে?
খত মাদের রে ভুয়াং এম জানামলেনা রে গড়া সাড়িমরে ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে
চেতে লাগিৎ ভুয়াং এম জানামলেনা রে চেতে লাগিৎ ভুয়াং এম বুসাঁড়লেনা রে
দেশ দাড়ান লাগিৎ ভুয়াং এম জানাম লেনা রে দিসম সাঙ্গার লাগিৎ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে"।
- - - ( সংগৃহিত)।

কোটা বহালের দাবিতে আদিবাসী ছাত্র পরিষদের মানববন্ধন

Image may contain: 2 people, people standing and people on stageImage may contain: 2 people, outdoor
Image may contain: 7 people, people standing and outdoor
কৃতজ্ঞতা: সাবিত্রী হেমব্রম,বাংলাদেশ
কোটা বহালের দাবিতে আদিবাসী ছাত্র পরিষদের মানববন্ধন
সরকারী চাকরিতে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্ধকৃত ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখার দাবিতে রাজশাহীতে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে মঙ্গলবার (২ অক্টোবর) সকালে রাজশাহী সাহেব বাজার জিরোপয়েন্টে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি গণকপাড়া মোড় থেকে শুরু হয়ে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে নগরীর জিরো পয়েন্টে সমাবেশের অয়োজন করা হয়।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নকুল পাহানের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুন মুন্ডা, রাজশাহী কলেজ শাখার সভাপতি সাবিত্রী হেমব্রম, চাঁপাইনাবাবগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক দিলীপা পাহান, কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক পলাশ পাহান, অর্থ সম্পাদক অনিল রবিদাস, প্রচার সম্পাদক পলাশ পাহান (২), সদস্য নয়ন পাহান, অনিল গজার প্রমুখ।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিলের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে সকল শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্ধকৃত ৫ শতাংশ কোটা বহালের দাবি জানান।
বক্তারা বলেন, বর্তমান সরকার সকলের দাবি পূরণ করছে আদিবাসীদের কোটা বহালের দাবিও পুরন করবে। আদিবাসীদের কোটা পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার আগেই সরকার আদিবাসীদের কোটা বাতিল করছে। আদিবাসীরা কোটা সুবিধা না নিতেই কোটা সুবিধা কেড়ে নিচ্ছে সরকার। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্ধকৃত কোটা বাতিল সংবিধানের ২৮ (৪) ও ২৯ (৩) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হবে। কোটা পর্যালোচনা কমিটিকে আদিবাসীদের কোটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আদিবাসী এলাকা গুলোতে গিয়ে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে আদিবাসীদের কোটা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে এবং সেই রিপোর্ট অনুযায়ী আদিবাসীদের কোটা বহালের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারের কাছে দাবি করেন বক্তারা।
এসময় আরো বক্তব্য দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ রাজশাহী মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আন্দ্রিয়াস বিশ্বাস, আদিবাসী নারী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক লিপি টুডু, কেন্দ্রীয় সদস্য ও আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি বিভূতি ভূষণ মাহাতো প্রমুখ।
সমাবেশের দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট লেখক ও কলামিষ্ট প্রশান্ত কুমার সাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাজশাহী জেলার সভাপতি কল্পনা রায়, জনউদ্যোগ রাজশাহীর ফেলো জুলফিকর আহমেদ গোলাপ, নবজাগর ছাত্র সমাজের উপদেষ্টা তামিম সিরাজী প্রমুখ।

Monday 1 October 2018

Saptahik atu Dulub.ASA/JDP.at-BAD PALSA.BAHALDA BLOCK.MBJ(O)

Saptahik atu Dulub.ASA/JDP.at-BAD PALSA.BAHALDA BLOCK.MBJ(O)
https://www.facebook.com/Hajam.Hansdah.9/videos/326023651507458/


হুদুরদুর্গার কাহিনীর বাস্তবতা সন্ধানে ইদানিং কতিপয় মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী

Image may contain: one or more people, people standing, plant and outdoor
হুদুরদুর্গার কাহিনীর বাস্তবতা সন্ধানে
- সমীর কুমার মন্ডল
ইদানিং কতিপয় মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী দাবী করে হুদুরদুর্গা অর্থ্যাৎ উপজাতীয় গল্পের রাজা মহিষ নাকি হিন্দু পুরাণ সমূহে বর্ণিত সেই মহিষাসুর এবং মা দূর্গা নাকি উপজাতীয় গল্প অনুসারে এক ছলনাময়ী দেবী! যা বাস্তবে নিতান্তই একটি ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
তবুও এইসব মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী নিজেকে হাইলাইট করার জন্য এই ভ্রান্ত ধারণার অগ্নিকুণ্ডে তেলের ছিটা মারার মতো কাজ করে এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের সাথে বাকি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরী করার জন্য এই হুদুরদুর্গার কাহিনীকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার।
আসুন এবার এক এক করে সত্যের দাঁড়িপাল্লাতে ওজন করে দেখে নিই এইসব কু-বুদ্ধিজীবীর প্রচার করা মন্তব্য গুলোতে কত ভাগ সত্য ও কত ভাগ মিথ্যা আছে।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
দেবী নামে কোন এক গৌরবর্ণা নারী তাঁদের রাজাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে গোপন ডেরায় অথবা তাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেছে। দুর্গা সাঁওতাল ভাষায় পুংলিঙ্গ। এর স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি দূর্গী। সাঁওতালী লোকসাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে যে তাঁদের রাজা দুর্গার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের(হুদুড়) মত। তিনি পরাক্রান্ত বীর।
[বিশ্লেষণ]
মন্তব্যটি অনেকটি দাদু দিদিমাদের শোনানো গল্পের ন্যায় যেখানে হঠাৎ করে এক রাজার কীর্তি শোনানো হয়। রাজা কি ভাবে জন্ম নিলো? কি ভাবে বড় হল? ইত্যাদি কোনো প্রসঙ্গই থাকে না সেখানে। যেখানে বক্তা শুধু বলে যাবে এবং শ্রোতা শুধু শুনে যাবে, যুক্তি প্রমাণের কোনো প্রসঙ্গই থাকে না সেখানে।
এখানে যে সাঁওতালী লোকসাহিত্যের কথা বলা হয়েছে সেটা কত বছরের প্রাচীন? সেটার ব্যাপারে উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী কোনো স্পস্ট প্রমাণের প্রসঙ্গ উল্লেখই করলো না!
বাস্তবে এই সাঁওতালী লোকসাহিত্যটি আধুনিক সময় কালে রচিত হয়েছে, এছাড়াও কোনো প্রাচীন সাহিত্যকার কে উক্ত বিষয় নিয়ে কিছু বর্ণনা করতে শোনা যায়নি এবং সুপ্রাচীন উপজাতীয় ভাষাই প্রাপ্ত লিপি গুলো থেকে এই হুদুরদুর্গা বা মহিষাসুরের কাহিনীর কোনো বর্ণনাও পাওয়া যায় না। কাজেই এই লোকসাহিত্যটি আধুনিক সময়কালে রচিত হয়েছে। এছাড়া কাহিনীর উক্ত রাজাটিও একটি সাহিত্যিক কাল্পনিক চরিত্র ছাড়া আর কিছুই নয়! কারণ কোনো মানুষের কন্ঠস্বর মেঘের মধ্যে গর্জন করা বজ্রের সম পরিমাণ প্রাবল্যতা বিশিষ্ট হয় না।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
আর্য সেনাপতি ইন্দ্র চাইচম্পাগড় আক্রমণ করে হুদূর দুর্গার হাতে পর্যুদস্ত হয়। পরপর সাতবার আক্রমণ করে পরাজিত হওয়ার পরে ইন্দ্র বুঝতে পারেন যে সরাসরি যুদ্ধে হুদুড়দুর্গাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই ছলনা এবং কৌশলের আশ্রয় নেন ইন্দ্র।
[বিশ্লেষণ]
প্রথমত, এই চাইচম্পাগড় ভারতের কোন প্রান্তে? এবং কত শতাব্দীর উল্লেখিত স্থান? সেটার সাপেক্ষে স্পস্ট প্রমাণ দেখিয়ে দেক উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয়।
দ্বিতীয়ত, ইন্দ্র কোনো আর্য সেনাপতি নয়! ঋক, সাম, যর্জু ও অথর্ব্বেদে উল্লেখিত মন্ত্রে ইন্দ্র শব্দের একাধিক প্রায়োগিক অর্থ আছে। তাই বেদে বর্ণিত ইন্দ্র কোথাও বৃষ্টি বর্ষণের নিয়ামক, কোথাও মানুষের ইন্দ্রিয়, কোথাও রাজ ধর্ম পালনকারী রাজা, কোথাও পরব্রহ্মের একটি গুণবাচক নাম। কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই ইন্দ্র প্রায়োগিক অর্থে একজন "আর্য সেনাপতি"। কাজেই ইন্দ্র কে আর্য সেনাপতি বানানোর আগে উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয় আগে প্রমাণ দেখিয়ে দেক বেদ সংহিতা থেকে যেখানে ইন্দ্র কে একজন আর্য সেনাপতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয় আগে একটি সু-প্রাচীন উপজাতীয় শিলালিপি বা পত্রলিপি থেকে এই হুদুরদুর্গা বা মহিষাসুর কাহিনীটি উল্লেখ আছে কি না দেখিয়ে দেক, তারপর মা দূর্গার উপর কুৎসা আরোপ করবে।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
হুদুড়ের রণকৌশলের মধ্যে কোন দুর্বলতা আছে কিনা এই খোঁজ শুরু করেন ইন্দ্র। ইন্দ্র জানতে পারেন যে অসুর নিয়ম অনুসারে এ দেশের রাজারা আশ্রিতের সাথে, শিশুর সাথে, দিবাবসানে, রাত্রে এবং নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। সুযোগ পেয়ে যান ইন্দ্র। তিনি লাবণ্যময়ী বারাঙ্গনা “দেবী”কে উপঢৌকন হিসেবে হুদূরদুর্গার কাছে প্রেরণ করেন। এক মহিষী থাকতে দ্বিতীয় নারীকে গ্রহণ করা যায় না এই অসুরনীতি মেনে দেবীকে প্রত্যাখ্যান করেন হুদূরদুর্গা। ইন্দ্র এবার নিজেই সন্ধির প্রস্তাব দেন। ঠিক হয় বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাঁরা বৈরিতা দূর করবেন। বিশ্বাস অর্জনের জন্য দেবীর সাথে হুদুড়দুর্গার বিয়ের প্রস্তাব দেন ইন্দ্র। হুদুড়দুর্গা আবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইন্দ্র জানান যে হুদুড়দুর্গা দেবীকে প্রত্যাখ্যান করলে লোকে তার পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। উপায়ান্তর না ভেবে হুদূড়দুর্গা দেবীকে বিয়ে করতে রাজি হন।
[বিশ্লেষণ]
আমি আগেই বলেছি উক্ত চরিত্র গুলি সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক উপজাতীয় সাহিত্যের দৃষ্টিকোণে, কাজেই উক্ত কাহিনীকার নিজের মতো করে ইন্দ্রের চরিত্র টিকে সাজিয়েছেন, যার সাথে ২০০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ঋগ্বেদে বর্ণিত ইন্দ্রের সাথে কোনো মিল নেই!
এছাড়া কাহিনীকার এখানে ধরা পড়ে গেলো অসুরের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আনুমানিক ৪০০ খ্রীস্টাব্দে রচিত অমরকোষের ১.১.২৩ অনুসারে অসুর = অ + সুর, সুর বলতে বোঝানো হয়েছে দেব স্বভাবকে অর্থ্যাৎ দেব স্বভাবের বিপরীত যার চরিত্র সেই হল অসুর।
এখন এই দেব স্বভাব কি? ও অসুর স্বভাব কি? তা দেখে নিতে পারেন গীতার নিম্নলিখিত এই নিবন্ধটি থেকে :-
(দৈবিক ও আসুরিক ব্যাক্তিকে চেনার উপায় কি ?)
আশা করি গীতাটা উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী নিশ্চয় মানেন? কারণ উনাদের প্রাণ প্রিয় জনক - ঠাকুর হরিচাঁদ তো আর গীতার বিরোধীতা করেন নাই! উলটে প্রশংসা করেছিলেন।
তাহলে অসুর স্বভাবের বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেলো অসুর স্বভাবের ব্যাক্তি না কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করে, না শিশু নারী আশ্রিতার বিচার করে যুদ্ধ করে, আর সবচেয়ে বড় চরিত্র হল ভোগবাদী স্বভাবের।
তবে এখান থেকে এটা পরিস্কার হচ্ছে হুদুরদুর্গার কাহিনীর রচয়িতার (অবশ্যয় আধুনিক যুগের) চরিত্রিক দিক দিয়ে ছিলেন অসুর স্বভাবের। তাই মহিষাসুর কে একজন আদর্শ রাজা হিসাবে জাহির করলেও, নিজের অজান্তেই নিজের আসুরিক স্বভাবকে প্রচ্ছন্ন ভাবে মহিষাসুরের উপর আরোপ করে ফেলেছেন তার সাহিত্যের কয়েকটি জাইগাতে, নিম্নরূপ :-
১. "তিনি লাবণ্যময়ী বারাঙ্গনা দেবী কে উপঢৌকন হিসেবে হুদূরদুর্গার কাছে প্রেরণ করেন" → উপহার হিসাবে নারী, নারী সম্ভোগী চরিত্রের প্রচ্ছন্ন প্রকাশ।
২. "ইন্দ্র জানান যে হুদুড়দুর্গা দেবীকে প্রত্যাখ্যান করলে লোকে তার পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে" → পুরুষত্ব হল বিবাহ করতে ভয় না পাওয়া, যৌনসংগমী চরিত্রের প্রচ্ছন্ন প্রকাশ।
৩. "একমাত্র রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে হুদুড়দুর্গা শস্ত্র খুলে রাখেন এবং তার দুর্ধর্ষ রক্ষীরা কাছে থাকে না" → দূর্বল মূহর্ত হল রাত্রে বিছানাতে, গভীর ঘুমে আসক্তির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ।
৪. "তাকে কামাসক্ত করে সুরাসক্ত করে মহাঘোরের মধ্যেই হত্যা করতে হবে। আদিবাসীদের বিশ্বাস নবমীর রাতেই দেবী নিজে আকন্ঠ সুরাপান করে এবং হুদুড়দুর্গাকে সুরাসক্ত অচৈতন্য করে" → মদে আসক্ত, নারী সম্ভোগে আসক্তির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ।
তাহলে রচয়িতার উক্ত প্রচ্ছন্ন মনোভাব থেকে কি প্রমাণ হচ্ছে?
তিনি কোন স্বভাবে আসক্ত?
এছাড়াও রচয়িতার উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু সমাজ থেকে উপজাতীয় গোষ্ঠীকে আলাদা করে রাখা, তাই নিজস্ব ব্যাক্তিগত হিন্দু বিরোধী মনোভাব পোষণ করার জন্য উনি উক্ত হুদুরদুর্গার কাহিনীকে উপজাতীয় সমাজে প্রচলিত করেছেন।
এখানে উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী হিন্দু গ্রন্থাকারদের উপর দোষ আরোপ করতে পারবে না, কারণ এই উপজাতীয় আধুনিক গ্রন্থাকারদের দ্বারা বর্ণিত মহিষাসুরের কাহিনীর বহু আগেই হিন্দু গ্রন্থকাররা মহিষাসুর কে একজন আসুরিক স্বভাবে আসক্তকারী হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
ইন্দ্রের আসল উদ্দেশ্য ছিল দেবীর মাধ্যমে হুদুড়দুর্গার দুর্বল মুহূর্তগুলির খোঁজ নেওয়া এবং সেই সুযোগে তাকে হত্যা করা। দেবীর মাধ্যমেই ইন্দ্র জানতে পারেন যে একমাত্র রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে হুদুড়দুর্গা শস্ত্র খুলে রাখেন এবং তার দুর্ধর্ষ রক্ষীরা কাছে থাকে না। বিয়ে করার অষ্টম দিনে হুদূড়দুর্গাকে হত্যা করার কৌশল ঠিক করে নিলেন ইন্দ্র। তিনি দেবীকে জানালেন যে নবমীর রাতেই হুদূড়কে হত্যা করতে হবে। তাকে কামাসক্ত করে সুরাসক্ত করে মহাঘোরের মধ্যেই হত্যা করতে হবে। আদিবাসীদের বিশ্বাস নবমীর রাতেই দেবী নিজে আকন্ঠ সুরাপান করে এবং হুদুড়দুর্গাকে সুরাসক্ত অচৈতন্য করে তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেয় এবং পরেরদিন ভোর রাতে তার দেহকে ইন্দ্রের শিবিরে নিয়ে আসে। হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করার ফলে তার নাম হয় “দেবীদুর্গা”
[বিশ্লেষণ]
আগেই উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেছিলো "দুর্গা সাঁওতাল ভাষায় পুংলিঙ্গ" তো এখানে দেবী নামক এক স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দের সাথে পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ কে যুক্ত করে, স্ত্রীলিঙ্গ বাচক নাম হিসাবে দেখাচ্ছে কেনো?
তাহলে সাঁওতাল ভাষা অনুসারে দেবীদূর্গা শব্দটি দিয়ে না কোনো নারী কে বোঝানো হচ্ছে, না কোনো পুরুষকে বোঝানো হচ্ছে!! উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবীর জোচ্চুরি তো এখানেই ধরা পড়ছে।
এছাড়া ৪০০-৬০০ খ্রীষ্টাব্দের দেবীমাহাত্ম্যম এর বর্ণনা অনুসারে অষ্টমী তিথিতে মহিষাসুর বধ হয়, তাই মহিষাসুরের বধের প্রতিক স্বরূপ ছাগ বলিটাও অষ্টমীতেই দেওয়া হয়। কিন্তু উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী এখানে বলছে যে নবমীতে হুদুড়দুর্গা বধ হয়েছে? তাহলে যদি প্রাচীন তথ্যগত মিলই না দেখাতে পারে তবে কিসের ভিত্তিতে দাবী করে উপজাতীয় কাহিনীর হুদুড়দুর্গাই হল হিন্দু পুরাণের মহিষাসুর এবং উপজাতীয় দেবীই হল দেবীমাহাত্ম্যমের মা দূর্গা?
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
দুর্গা কে? এই নিয়ে লোকসাহিত্যে নানা কাহিনী রয়েছে। একটি কাহিনীতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্র মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যের বিখ্যাত বারাঙ্গনা অ্যানির সাহায্য গ্রহণ করেন। বারাঙ্গনা অ্যানি মহিষাসুরকে কামাসক্ত করে অচৈতন্য অবস্থায় তাকে হত্যা করেন।
আর একটি উপ কথায় পাওয়া যায় এই নারী ছিলেন ইন্দ্রের নিজের বোন দেবী। অন্যদিকে ভীল আদিবাসীরা দাবী করেন দুর্গা তাদের মেয়ে। দেবতারা তাকে শিবিরে নিয়ে গিয়ে মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। দেবীর আর এক নাম চণ্ডী। হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দাবী চণ্ডী তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাকে দিয়ে তাঁদেরই রাজাকে হত্যা করে।
সাঁওতালরা দাঁসায় গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন যে হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে ইন্দ্র চাইচম্পাগড় থেকে আদিবাসীদের বিতাড়িত করেন। তাই আজও বুক চাপড়ে ও হায়রে-ও হায়রে আওয়াজ করে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে আদিবাসীরা তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। বরাঙ্গনা দেবী দূর্গার হাতে হুদুরদুর্গার বা মহিষাসুরের হত্যার কাহিনী এভাবেই লোকায়ত হয়ে আছে আদিবাসীদের মধ্যে।
আদিবাসীদের এই লোকসাহিত্যের অনেকটাই সমর্থন পাওয়া যায় নানা পুরাণ কাহিনীতে। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দোর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা”। অর্থাৎ দুর্গা নামক অসুরকে বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা হলেন।দেবীপুরানে যে ঘোড়াসুরের বর্ণনা পাওয়া যায় তা হুদুড়দুর্গাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
[বিশ্লেষণ]
উক্ত অংশ দেখে এটা বোঝা যাচ্ছে মা দূর্গার পরিচয় নিয়ে উক্ত মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে আছেন, তাই এক এক আদিবাসী ও উপজাতিরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন উনি সেটি নিজেই উল্লেখ করেছে। তাহলে এখান থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে উপজাতীয় কাহিনীতে বর্ণনাকারী ছলনাময়ী নারী কে হিন্দুদের আরাধ্য মা দূর্গা বলাটি একটি আন্দাজে ঢ়িল ছোঁড়া ব্যাতিত অন্য কিছু নয়!
এছাড়া এখানে যে মতুয়া কু-বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেছেন - "হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে ইন্দ্র চাইচম্পাগড় থেকে আদিবাসীদের বিতাড়িত করেন" এর প্রমাণ কি তারা কোনো ঋগ্বেদের সমতুল্য খ্রীস্টপূর্ব প্রাচীন আদিবাসী বা উপজাতীয় লিপি থেকে দেখাতে পারবে?
লেখকের হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে সিকিভাগও জ্ঞান নাই তাই ইন্দ্রের উপর উক্ত আরোপ এনেছে, বৈদিক সাহিত্যে ইন্দ্র হল একটি বৈদিক আধ্যাত্মিক প্রায়োগিক অর্থ বা গুণ সমূহের প্রতিক - যা দিয়ে বৃষ্টির নিয়ামক, একজন আদর্শ রাজা, মানুষের ইন্দ্রিয়, পরব্রহ্ম, রক্ষকর্তা, যাজ্ঞিক ইত্যাদি কে বুঝানো হয় এবং পুরাণে ইন্দ্রের মাধ্যমে - রাজা, ঋষি, বীর পুরুষ, দেবত্ব, মনুষ্য প্রবৃত্তি, রজঃ গুণ প্রভৃতির আধ্যাত্ম ও দার্শনিক উপমা হিসাবে বোঝানো হয়।
এরপর প্রসঙ্গ তুলেছেন শব্দকল্পদ্রুমের! যা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭) দ্বারা সংকলিত একটি সংস্কৃত অভিধান, এখানে যে “দোর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা” বলা হয়েছে তার উৎস হল দেবীমাহাত্ম্যমের ৭/২৮/৭৪-৮০। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে দূর্গম নামক অসুরকে বধ করেই আদিশক্তি নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা হলেছিলেন।
এই দূর্গম অসুর সম্পর্কে দেবীভাগবতের ৭/২৮/৪-১০ তে বলা হয়ে সে ছিলো রাক্ষস রাজ হিরণ্যাক্ষের বংশভূত এক অসুর, চারিত্রিক দিক দিয়ে ছিলো অতিব নিষ্ঠুর প্রকৃতির এবং যজ্ঞের হবি সমগ্রহ চুরি করাই ছিলো তার জীবিকা। এবার উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী নিজেই বিচার করুক দূর্গম কাদের দৃষ্টিকোণে একজন আদর্শ রাজা হবে?
এছাড়া এখানে কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয় যে দাবী করেছে "দেবীপুরানে ঘোড়াসুরের বর্ণনা নিয়ে" তা নিছক তাদের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়! কারণ ঘোড়াসুরের আরেক নাম হল "কেশী" যে শ্রীকৃষ্ণের হাতে বধ হয়েছে, যার বর্ণনা দেবীপুরাণ নয় বরং বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত পুরাণ ও হরিবংশ প্রভৃতি জাইগাতে আছে। যেহেতু কেশী নামটা লিখলে কু-বুদ্ধিজীবীর জোচ্চুরি অনেকে ধরে ফেলবে তাই বিকল্প হিসাবে ঘোড়াসুর লিখেছে। এছাড়া তারা যে ছবিটি কে তাদের পোস্টে এড করে মহান হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুর বলে চালাচ্ছে
বাস্তবে সেটি হল কৃষ্ণের কেশী বধের একটি পাথরের মূর্তি, যা আনুমানিক গুপ্ত যুগের এবং বর্তমানে যা মেট্রোপলিটান মিউসিয়াম অফ আর্টে রেখে দেওয়া হয়েছে।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
'সার্বনি' নামে অষ্টম মনুর মন্বন্তরের সময় যখন পুরন্দর দেবতাদের ইন্দ্র হয়েছিলেন (মার্কন্ডেয় পুরান 80 অঃ) সেই সময় রম্ভাসুরের পুত্র ' ঘোরাসুর' কুশদীপের অধিপতি ছিলেন। সেই ঘোরাসুরই মহিষাসুর নামে খ্যাত (দেবীপুরান- 1ম অঃ)। তিনি নিজে বাহুবলে জম্বুদ্বীপ, ক্রোঞ্চদ্বীপ, শাল্মদ্বীপ, পুস্করদ্বীপ, মানসদ্বীপ (স্বর্গ) ও নাগরাজ (পাতাল) জয় করে সপ্তদীপ ও সপ্তসমুদ্রের অধিপতি ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বলবান, বীর্যবান, বুদ্ধিমান, ও সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শি তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ন, সংযমী, বিলাসহীন, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতাবাদের আদর্শে প্রজাহিতৈষী। প্রজাগন শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বুকের মধ্যে খোদাই করে রাখত (দেবি পুরান -2 ও 16 তম অঃ)। পরস্ত্রী কে তিনি সর্বদা কন্যা ও মাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন (দেবিপুরান ষোড়ষ অধ্যায় শ্লোক নং 2-12) । তার মতো সর্বগুন সম্পন্ন মহান রাজা মহাভারত, রামায়ন এমনকি অনান্য পুরাণ কাহিনীগুলিতেও দ্বিতীয় কোনো রাজার পরিচয় পাওয়া যায় নি। কেবলাত্র রাজা হরিশচন্দ্রের মধ্যে কিঞ্চিৎ এই গুন থাকলেও হরিশচন্দ্রের তুলনায় তিনি বহুগুনে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
[বিশ্লেষণ]
কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয় এখানে এসে জোচ্চুরির সব সীমা অতিক্রম করে গেছেন। এখানে তিনি বলছেন রম্ভ অসুরের পুত্র নাকি ঘোড়াসুর (কেশী)! মহিষাসুর থাকলে হয়তো এটা শুনে উনার পশ্চাৎদেশে গুঁতোতেন।
তবে এখানেই শেষ নয়, উনি যে দেবীপুরাণ ও মার্কন্ডেয় পুরাণের রেফারেন্স গুলি প্রদান করেছেন তার সাথে মূল দেবীপুরাণ বা মার্কন্ডেয় পুরাণের কোনো মিল নেই, নিম্নরূপ :-
* সার্বনি' নামে অষ্টম মনুর মন্বন্তরের সময় যখন পুরন্দর দেবতাদের ইন্দ্র হয়েছিলেন (মার্কন্ডেয় পুরান 80 অঃ)
→ অর্ধসত্য কথা! উক্ত অংশে কি বলা হয়েছে নিজেই দেখুন :- (লিংক এ দেখুন)
* সেই সময় রম্ভাসুরের পুত্র ' ঘোরাসুর' কুশদীপের অধিপতি ছিলেন। সেই ঘোরাসুরই মহিষাসুর নামে খ্যাত (দেবীপুরান- 1ম অঃ)।
→ পুরো মিথ্যা কথা! দেবীপুরাণের প্রথম অধ্যায় উক্ত মন্তব্যের বিন্দুমাত্র অংশ নেই, এই অধ্যায়ে দেবীপুরাণের ভূমিকা, পুরাণের তাৎপর্য, পুরাণের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা করেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় এখানে ঘোড়াসুর নাম পর্যন্ত নেই! এরজন্য বোধয় কু-বুদ্ধিজীবী মহাশয় রেফারেন্সে অধ্যায় নং লিখে ছেড়ে দিয়েছে। স্কন্ধ নং, অধ্যায় নং, শ্লোক নং আর ভয়ে উল্লেখ করেন নাই।
* তিনি নিজে বাহুবলে জম্বুদ্বীপ, ক্রোঞ্চদ্বীপ, শাল্মদ্বীপ, পুস্করদ্বীপ, মানসদ্বীপ (স্বর্গ) ও নাগরাজ (পাতাল) জয় করে সপ্তদীপ ও সপ্তসমুদ্রের অধিপতি ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বলবান, বীর্যবান, বুদ্ধিমান, ও সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শি তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ন, সংযমী, বিলাসহীন, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতাবাদের আদর্শে প্রজাহিতৈষী। প্রজাগন শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বুকের মধ্যে খোদাই করে রাখত (দেবি পুরান -2 ও 16 তম অঃ)।
→ আবার জোচ্চুরি! দেবী পুরাণের রেফারেন্স স্কন্ধ, অধ্যায় ও শ্লোক আকারে হয়, কিন্তু লেখক এখানে শুধু অধ্যায় বলে ছেড়ে দিলেন কিন্তু ওই অধ্যায়টি কত স্কন্ধের তার স্পস্ট আর করলেন না এবং শ্লোক নং টাও উল্লেখ করলেন না।বাস্তবে কু-বুদ্ধিজীবীরা উক্ত মন্তব্যটি নিজেই লিখেছেন এবং পুরাণের নাম ও অধ্যায় লিখে সেটাকে পৌরাণিক বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
* পরস্ত্রী কে তিনি সর্বদা কন্যা ও মাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন (দেবিপুরান ষোড়ষ অধ্যায় শ্লোক নং 2-12) । তার মতো সর্বগুন সম্পন্ন মহান রাজা মহাভারত, রামায়ন এমনকি অনান্য পুরাণ কাহিনীগুলিতেও দ্বিতীয় কোনো রাজার পরিচয় পাওয়া যায় নি। কেবলাত্র রাজা হরিশচন্দ্রের মধ্যে কিঞ্চিৎ এই গুন থাকলেও হরিশচন্দ্রের তুলনায় তিনি বহুগুনে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
→ "চোরের মায়ের বড় গলা" বাগধারাটির প্রয়োগ কোথাও দেখেছেন? না দেখলে এখানে দেখে নেন।
প্রথমে, কু-বুদ্ধিজীবীরা নিজে মনগড়া মন্তব্য লিখে সেটাকে পৌরাণিক মন্তব্য বলে চালিয়ে দিলেন। এরপরে পাবলিক কে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা রেফারেন্স গুলো যোগ করলেন, এখানেই শেষ নয় - দেবীপুরাণের যে ১ম, ২য় ও ১৬নং অধ্যায় কে রেফারেন্স হিসাবে দিয়েছেন তার অধ্যায় ভিত্তিক বিষয় বস্তু পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
বস্তুত লেখক এই দেবীপুরাণ ও মার্কন্ডেয় পুরাণ আদৌও দেখেছে কি না সন্দেহ আছে। উক্ত লেখক আবার এর মধ্যে আবার রাজা হরিশচন্দ্র কে টেনে আনলেন! কু-বুদ্ধিজীবী লেখক হয়তো জানেন না পৌরাণিক গ্রন্থ শুধু নয়, খ্রীস্টপূর্বাব্দ প্রাচীন বৈদিক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ সমূহে রাজা হরিশচন্দ্রকে একজন ন্যায়বান ও দানবীর রাজা হিসাবে মর্যাদা প্রদান করেছে, সেই তুলনায় খ্রীস্টপূর্বাব্দ প্রাচীন কোনো উপজাতীয় শিলালিপি বা পত্রলিপিতে এই হুদুড়দুর্গা, ঘোড়াসুর বা মহিষাসুরের নামটিরও উল্লেখ নেই।
[কু-বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য]
কোন সর্বগুণ সম্পন্না, কল্যাণময়ী নারীকে যেমন মহিষী বা মহিয়সী উপাধী দেওয়া হয় তেমনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে ঘোড়াসুরকে মহিষ , মহিয়ষ তথা (মহিষ+ অসুর ) মহিষাসুর উপাধি তে ভূষিত করা হয়েছিল। পরবর্তী কালের পুরাণগুলিতে বিশেষ করে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং ইদানীং কালের মহিষাসুর মর্দিনীতে মহিষাসুরকে মহিষের গর্ভজাত অথবা মহিষেররূপী এক মায়াবী এবং দুরাচারী অসুর হিসেবে দেখানো হয়। মূলত দুর্গা শক্তির নামে এক ব্রাহ্মন্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর জন্যই জনকল্যাণকারী, মঙ্গলময় আদিকৌম সংস্কৃতির মহান রাজা হুদুড় দুর্গা, ঘোড়াসুর বা মহিষাসুরকে 'অশুভ শক্তি'র প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
[বিশ্লেষণ]
সেইভাবে যদি কু-বুদ্ধিজীবী লেখকের দৃষ্টিকোণে বিচার করি তো পাবো ইংরেজি fool এবং বাংলা ফুল একই জিনিস!
মহিষী বা মহিয়সী (স্ত্রীলিঙ্গ) বলতে বোঝানো হয় রাজপত্নী হিসাবে অভিষিক্তা নারী বা রাজ কন্যা কে এবং এই মহিষীর পুংলিঙ্গ টি হল "মহিষ" যা দিয়ে বোঝানো হই কোনো রাজা কে, সেখানে মহিষাসুর = মহিষ + অসুর অর্থ্যাৎ যিনি অসুরদের রাজা (লেখকের দৃষ্টি সাপেক্ষে বিচারে)।
এছাড়া আমি আগেই বলেছি আনুমানিক ৪০০ খ্রীস্টাব্দে রচিত অমরকোষের ১.১.২৩ অনুসারে অসুর = অ + সুর, সুর বলতে বোঝানো হয়েছে দেব স্বভাবকে অর্থ্যাৎ দেব স্বভাবের বিপরীত যার চরিত্র সেই হল অসুর।
এখন এই অসুর স্বভাব কি রকম? তা দেখে নেন গীতা থেকে
:- (দৈবিক ও আসুরিক ব্যাক্তিকে চেনার উপায় কি ?)
কাজেই সহজ ভাষাই বলতে গেলে মহিষাসুর হল - ভোগবাদী, অধার্মিক, অশুচি, কদাচারী, জোচ্চোরী ইত্যাদি গুণবাদীদের রাজা। তাই মহিষাসুর হিন্দু পৌরাণিক দৃষ্টিকোণে পশুত্ব ও অসুরত্ব উভয় গুণের অধিকারী, এর জন্য পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে মহিষাসুরের জন্ম হয়েছে মহিষ (পশু) ও অসুরের মিলনের ফলে, তার নাম পুরাণকারেরা রেখেছেন মহিষাসুর।
বাকি থাকে ঘোড়াসুর বা কেশীর কথা তবে সে কোনো ভাবেই মহিষাসুর নয়। পৌরাণিক ঘটনা গুলোর সাপেক্ষে কেশীর আর্বিভাব হয়েছে মহিষাসুরের মৃত্যুর বহু পরে।
শেষে লাইনে উক্ত লেখক আবার সনাতন ধর্ম নিয়ে ঘেউ ঘেউ করেছে অনেকটা "চোরের মায়ের বড় গলার" মতো ব্যাপার।
এখানে যে মা দূর্গা কে নিয়ে উক্ত কু-বুদ্ধিজীবী এতো ঘেউ ঘেউ করেছেন, হিন্দুদের দৃষ্টিকোণে সেই মা দূর্গা কে? এবং কি? দেখে নিতে পারেন নিম্নলিখিত নিবন্ধ থেকে :-
(দূর্গাতত্ত্ব)
সবশেষে উপজাতীয় ও মতুয়া ভাই ও বোনেদের বলবো এইসব ভণ্ড বুদ্ধিজীবীদের কথাই কর্ণপাত করে অহেতুক সাধারণ হিন্দুদের সাথে বিবাদে জড়াবেন না। এইসব ভণ্ডদের কাজই হল ব্রিটিশদের divided and rule এর নীতির মতো কাজ করে এক বিশেষ গোষ্ঠীদের কাছে celebrity হওয়ার এবং পলিটিকাল ফাইদা লুটা।
আর সত্য কে স্বীকার করতে শিখুন আধুনিক উপজাতীয় লোকসাহিত্যের মহিষাসুরের ও হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রের মহিষাসুর কোনো ভাবেই এক নয়! এবং মা দূর্গা না কোনো ছলনাময়ী নারী!
লিংক :-[হুদুরদুর্গার কাহিনীর বাস্তবতা সন্ধানে] is good,have a look at it!

বীরভূম জেলার সিউড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাজাল এর নামে মেলা

 বীরভূম জেলার সিউড়ির বড়বাগানের আব্দারপুর ফুটবল ময়দানে আয়োজিত হতে চলেছে ‘বীরবান্টা বাজাল মেলা-২০১৯’। ১৯শে জানুয়ারি এই মেলা আয়োজিত...