SANTHALDISHOM(সানতাল দিশোম): 04/17/20

Friday 17 April 2020

জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় ‘বাহা মা মড়ে’ উৎসব

ডা.তিলক পুরকায়স্থ

জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা গরমে চলেছি ধামসা মাদলের খোঁজে- বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে। এখানে বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় “বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান” । আমার এই যাত্রার উদ্দেশ্য আমার দেশ, আমার বাংলা, আমার ভারতবর্ষের দর্শন ।
সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে কিছু বলা যাক।এরা বিশ্বাস করে এদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন একলব্য, যাঁকে অত্যন্ত অন্যায় ভাবে দ্রোণাচার্য তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিসাবে চেয়েছিলেন। তাই জানেন কিনা জানিনা, আজকেও সাঁওতালরা তীর ছোড়ার সময় বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে না। অবশ্য এরকম অন্যায় কাজের উদাহরণ তো আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ঘটেছে- শত শত একলব্য, শম্বুকদের কথা আর কেই বা মনে রাখে !সাঁওতালরা কিসকু, মুর্মু, হাঁসদা, সরেন, টুডু,মানডি, বাস্কে এই সাতটি গোষ্ঠী বা গোত্রে বিভক্ত।
সাঁওতাল নামে এঁদের পরিচিতি পরে হয়েছে, আদিতে সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, মাহালি সবাই এরা পরিচিত ছিল খেরওয়াল গোষ্ঠী হিসাবে। পরে অনেক ছোট ছোট গোষ্ঠী খেরওয়াল গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তোলে, অনেকে হিন্দুও হয়ে যান। যেমন শুধু ঝাড় খণ্ডের কথাই যদি ধরি তাহলে দেখতে পাচ্ছি সাঁওতাল ছাড়াও ঝাড়খণ্ডে সর্বমোট ৩২ টি জন জাতির বাস। এদের মধ্যে পুরোপুরি কৃষিজীবী জন জাতি হচ্ছে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো,ওঁরাও , খারিয়া, ভূমিজ ইত্যাদি। পক্ষান্তরে বিরহর, পাহাড়ি খারিয়া ইত্যাদি জাতির আদিতে শিকার করাই ছিল মুখ্য জীবিকা। শিল্প এবং দৈনন্দিন ব্যাবহারের সামগ্রী তৈরি করত মালহার, লোহার, কারমালি, অসুর ইত্যাদি জনজাতি। পাহাড়িয়া জনজাতির লোকেরা ঘুরে ঘুরে কৃষিকাজ করতেন।
সাঁওতাল উপজাতিদের বাহা- মা: মড়ে উৎসবে মেতে ওঠার আগে এবং কিছু বলার আগে রাঢ় বাংলা এবং বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কিছু দরকার আছে বলে মনে হয়।আমরা বাঙালিরা গর্বিত আর্য জাতি, আমাদের নিয়ে কবি লেখেন-” মোক্ষ মুলার বলেছে আর্য,/ সেই থেকে মোরা ছেড়েছি কার্য।”
দেখেনি আমরা কতটা আর্য, আর যাঁদের আমরা অনার্য বলছি, তাঁদের নিয়েও কিছু আলোচনা করছি।আর্য জাতি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভারতে, ভালো করে বললে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত আছে, বাংলাদেশে তখন আদিতম দ্রাবিড় গোষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম জনজাতি গোষ্ঠী বা প্রটো অস্ট্রোলয়েড গোষ্ঠীর লোকেদেরই বসবাস। এরা ছিল অতি উন্নত জাতি, এরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত।
পরবর্তী কালে অবৈদিক আর্য যেমন আলপিও, দিনারিও ইত্যাদি জন গোষ্টিও বাংলার মাটিকে বাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করে থিতু হয়ে বসে। এই দ্রাবিড় এবং মুখ্যত অবৈদিক আর্য আলেপিও , দিনারিও গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে অস্ট্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক গোষ্ঠীর মিলনের ফলেই আজকের বাংলাদেশের বাঙালি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি। অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছে মিশ্র শংকর জাতি।বৈদিক আর্যদের বঙ্গ বিজয় এবং বৈদিক সংস্কৃতির আবির্ভাব এর অনেক পরের ঘটনা।বঙ্গ সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব নিয়ে বলা যায় যে নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি যে উন্নত জাতি তার কারণ হচ্ছে, বাঙালির রক্তে আছে তিনটি সভ্যতার – প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রণ। তাই বঙ্গ সংস্কৃতি বলতে কেবল ব্রাহ্মণ‍্য সংস্কৃতি আদৌ বোঝায় না। এর পরতে পরতে মিশে আছে আদিম জনজাতি, অবৈদিক সভ্যতার প্রভাব। এর সঙ্গে সংযুক্তি করন ঘটেছে বৌদ্ধ ও জৈন সংস্কৃতির প্রভাব। অর্থাৎ এই ভারতের মহামানবেরা হচ্ছেন আদিম যুগ থেকে বসবাসকারী অসংখ্য জাতি-উপজাতিরা।
টর্চের আলোয় আমগাছে মুরগি
তাই বিদেশি পন্ডিতেরা যখন বলেন বহিরাগত আর্যদের দ্বারা ভারতবর্ষের সু সভ্যতার প্রচলন ঘটেছে, এমন কি ভারতীয় ধর্ম চেতনা ও বৈদিক মন্ত্র সমূহ, বহিরাগত আর্যদের দান, তখন বোঝা যায়, এনাদের চেতনায় ছড়িয়ে আছে, ভারতীয়দের সম্মন্ধে এক তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাব। বাইরের সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই ভারতীয়রা সভ্য হয়েছে। এর থেকে মিথ্যা মিথ আর হয়না- অতি উন্নত সিন্ধু সভ্যতার প্রচলন কারা করেছিল ? কোথায় ছিল তখন সভ্য আর্যরা ?
সুর- অসুর, আর্য-অনার্য ইত্যাদি শব্দগুলি নিয়ে চমৎকার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন সুহৃদকুমার বাবু তাঁর আর্য রহস্য বইয়ে। তাঁর লেখা কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-” আমরা সকলেই জানি যে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, খুব কম হলেও চারটি মৌলিক ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের সমবায়ে গঠিত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। কাল অনুসারে তারা হল অস্ট্র-এশিয়াটিক কোল গোষ্ঠী দ্রাবিড়, ইন্দো- যুরোপীয় বেদিয়া শ্রেণী ও ভোটচিনীয়।। ম্যাক্স মুলরের সময় থেকে বিনা কারণে যাযাবর জাতিটি সহসা আর্য নামে অভিহিত হতে লাগল।ঐ যাযাবর জাতিটি ছাড়া অপর সকলেই ছিল স্থায়ী বসবাসকারী কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী। আর যাযাবর বেদিয়ারা স্থায়ী বসবাসকারী মানুষের কাছে আসত ঔষধ বিক্রয় করতে, তুকতাক করতে আর সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য দুর্বোধ্য সব জাদুমন্ত্রে ভগবানকে ডাকতে।…..”
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তন সমানে ঘটেছে। প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রনে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর আগেই তৈরি হয়েছে পূর্বমগধী জাত প্রাকৃত ভাষা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সপ্তম শতকে বঙ্গে আগত চৈনিক পর্যটক হিউএন সাংগের বর্ণনায়।আদি মানভূম, সাঁওতাল পরগনা, বাঁকুড়া ইত্যাদি স্থানের ( হিউএন সাংগের বর্ণনায় যে কজঙ্গল পাওয়া যায় তা কিন্তু একদিকে ছোট নাগপুরের মালভূমি, অন্য দিকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝর এবং বালেশ্বর অবধি বিস্তৃত ছিল।)এখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমতল নদীয়া এবং বর্তমানের কলকাতার ভাষা ও সংস্কৃতির থেকে বেশ কিছুটা আলাদাআরেকটা কথা- সাঁওতালরা প্রকৃতির উপাসক, মূর্তি পুজো করেনা।
নাইকির উঠোনে প্রথম রাতের গানের আসর
দুই
রাত প্রায় আটটা, আমরা এসে পৌঁছেছি , বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে । এখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান , পুরোহিত বা নায়কের বাড়ীতে। সিমলাপাল থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ১০ কিমি র মতন।
আমরা উঠেছি, শ্রী মহেন্দ্রনাথ সরেন এই বাঁশকানালি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। এনার ছোটভাই ডাক্তার এবং আমার স্ত্রীর সহকর্মী। ডাক্তার ও সপরিবারে এসেছে। একগাড়ি পল্টন এসে তিনদিনের জন্য খুঁটি গেড়ে বসলাম, মোড়লের বাড়িতে। কিন্তু মোড়ল ই তো এই আনন্দ উৎসবের মুখ্য হোতা। আমাদের সামলাবে কে ? কুছ পরোয়া নেই, মোড়ল মশাইয়ের বৌদি, আমাদের সবার বড় বৌদি, সদা হাস্যময়ী , সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা- মকরি সরেন বৌদি স্বেচ্ছায় সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার আগে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা এসে সোনা রঙের কাঁসার ঘটি থেকে জল ঢেলে, কাপড় দিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে, একে একে সবাই ভূমিষ্ট হয়ে প্রনাম করল। কিচ্ছু করার নেই, এই রীতিই এখানকার দস্তুর। সরল আদিবাসীদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় চোখ ভিজে উঠবে। নব্য বঙ্গজদের কাছে, এসব হয়ত ফালতু মনে হবে। বাচ্চা মেয়ে বলতে যাঁদের বুঝিয়েছি, সেই শান্তি হেমব্রম, শ্যামলী সরেন ইত্যাদি ভাইজি, ভাগ্নীরা সবাই কমপক্ষে এম এ পাস এবং স্কুল শিক্ষিকা।
বিশাল উঠোন, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সারি সারি খাটিয়া পাতা। এতেই চলেছে, গান, আড্ডা, নাচের মহড়া। তালবাদ্যের রণ সংগীতে, এর মধ্যেই রক্ত গরম হতে শুরু করেছে। ঝকঝকে নিকানো উঠোনে, এই বাড়ির মেয়েদের হাতে বোনা আসনে বসে, বড় বৌদির হাতের অমৃত সম রান্নার স্বাদ, সারা জীবনের মণিকোঠায় তোলা থাকলো।রাত নয়টা থেকে পুরোহিতের বাড়িতে তুলসীমঞ্চকে ঘিরে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান । আধো অন্ধকারে এক আধি দৈবিক, আধি ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ধামসা, মাদল, রেগড়া, সাঁকোয়া কত রকম বাদ্যযন্ত্র , বিশাল জায়গাজুড়ে কি অসাধারণ একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, লিখে বোঝান যাবেনা। তিনদিনের উৎসবের আজকে অনুষ্ঠানের প্রথম দিন, ওঁম ।
মোড়লের ঘর
মোড়ল মশাইকে ঘিরে গল্প শুনছি। ঠিক গল্প নয়, অজানা সংস্কৃতির গল্প। এই গল্প আমাদের শোনানো হয়না। যে অস্ট্রিক সভ্যতা- ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি, তাঁদের কথা তাঁদের উত্তরসূরিদের মুখ থেকেই শোনা যাক।
মহেন্দ্রনাথ সরেন হচ্ছেন মোড়ল বা মাঝি হাড়াম। ইনি হচ্ছেন এই গ্রাম সমাজের মুখ্য কর্তা। এ ছাড়াও আরো চারজন কর্তা আছেন। পারানিক বা পরামানিক , পরামানিকের সহকারী- জগ পারানিক, গোড়ায়েৎ বা কাইলি( উৎসবের বার্তাবাহক), জগ মাঝি( মরাল পুলিশ বলা যায়)।
এই যে বাহা- মা মড়ে অনুষ্ঠানে আমরা এসেছি, এর নির্ঘন্ট কিন্তু তৈরি করেছেন- সমাজ কর্তারা মিলে । একটি (জেনারেল বডি মিটিং) আলোচনা সভা বা ” কুলহি দুড়ুপ:” এ বসে এই নির্ঘন্ট তৈরি হয়েছিল।
মা: অর্থ জাহেরআয়ু মা, যিনি আবার সৃষ্টিকর্তা মারাং বুরুর স্ত্রী। আর মড়ে অর্থ পাঁচ। বৃহত্তর অর্থে পাঁচ ঠাকুরের কাছে মানসিকের কমপক্ষে পাঁচটি পাঁঠা/ছাগল বলি। বসন্ত উৎসবের বা ফুলের উৎসবের অনুষ্ঠান বাহা পড়ব তো চৈত্র মাসে হয়ে গেছে। কিন্তু বংগা দেবতার থানে যারা মানসিকের ব্রত করেছিল, সেই মানসিকের ব্রত রাখা মানুষ গুলির জন্য, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় এখানে পালন করা হয় মা: মড়ে উৎসব। মারাং বুরু, জাহেরআয়ু, মড়ে-কো-তুড়েইক, সেন্দ্রা বঙ্গা, হারাং বঙ্গা- এই পাঁচটি মুখ্য দেব-দেবীর থানে চারটি পাঁঠা ও একটি ছাগি বলি হচ্ছে পুজোর অঙ্গ। জাহের আয়ু দেবীর নামে ছাগি বলি হয়।এই মুখ্য দেবতাদের থানেই আছেন রস্কে বঙ্গা। ইনি সাঁওতাল সমাজের রসে বসে থাকা আনন্দের ঠাকুর বলতে পারি।
রাত একটায় সময় এতজন বসে
এই বলি উৎসব কিন্তু হবে দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ আগামীকাল, যাকে বলা হয় সারদি-র দিনে।রাত নয়টায় ঢুকলাম- প্রধান পুরোহিত বা নাইকির বাড়ির উঠানে। লোকে লোকারণ্য। দুই দিকে বাজনাদারেরা বসে গ্যাছে তাঁদের বাজনার যন্ত্র নিয়ে।আরেকদিকে মেয়েরা বসে। বাকি দিকে নাইকি- বীরেন সরেনের ঘর। মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে, নাইকির উঠানের তুলসী মঞ্চ ঘিরে। নাইকির সহকারী একটি কম বয়সী ছেলে- যাকে ডাকা হয় ” কুডম নাইকি” বলে।
একদিকে পুজো আর্চা চলছে, মাঝে মধ্যে ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। সমস্ত ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে দিয়ে একটিমাত্র হ্যাজাকের আলোতে এতবড় অনুষ্ঠান চলছে।
ধামসা, মাদল, খোল এগুলি সবই হচ্ছে আনন্ধ শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র, অর্থাৎ প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র চামড়ার আচ্ছাধন দিয়ে তৈরি।ধামসা বা নাগারা আদিতে রণসঙ্গীত হিসাবে যুদ্ধের সময় বাজানো হত। তবে বর্তমানে মানভূম এবং ছোটনাগপুর জেলার বিভিন্ন নৃত্যগীত এবং শোভাযাত্রায় ব্যাপকভাবে এটি বাজানো হয়। ধামসা বা নাগারার অন্য নামগুলো হচ্ছে টিকারা, দামামা, ঢক্কা, ডঙ্কা ইত্যাদি( Samuel Johnson 1834, A Dictionary in English and Bengalee.)
আগে শিশুকাঠ দিয়ে ধামসার খোল তৈরি হতো। তবে বর্তমানে লোহার চাড়ির মুখে গরু বা মহিষের চামড়া দিয়ে এর ছাউনী তৈরি হয়। ছাউনী তৈরিতে গাব(গাব ফলের আঠা) বা খিরণ লাগানো হয় না।
ধামসা দুটি মোটা কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। ধামসা কিন্তু ছোট ও বড় – দুটি মাপের হয়। বোলের শব্দ শুনে দ্রিমি দ্রিমি, দ্রিম দ্রিম ধ্বনি বলে মনে হয়। বাঁশ পাহাড়ির অনুষ্ঠানে দুই সাইজের ধামসা দেখতে পেলাম।
প্রায় এরকমই আওয়াজ বেরোচ্ছে আরেকটি বিশাল বাদ্যযন্ত্র থেকে। এটির নাম রেগড়া। এটি কিন্তু সমান দৈর্ঘ্যের দুটি কাঠি দিয়ে বাজানো হচ্ছে।
বিশাল আকারের মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। শিঙের মধ্যে একটি ফুটো থাকে। এই ফুটোতেই ফুঁ দিয়ে সুর তুলছে। মধ্যে মধ্যে শিল্পীকে যন্ত্রের মধ্যে জল ঢেলে পরিষ্কার করতে দেখলাম। সাঁকোয়া বহু প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। একজন শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হল- ওনার নাম লখিন্দর মুর্মু। উনি এই যন্ত্র বাজাতে শিখেছেন উনার গুরু মহেন্দ্রনাথ সরেনের কাছে।
নাইকি ও তাঁর সহকারী কুডম নাইকি
এবার আসি মাদলে।
মাদল দেখতে অনেকটা সিলিনড্রিকাল , এরকমই দেখতে একটু ছোট বাদ্যযন্ত্র কে লাগা বলে। এটি তৈরিতে পোড়ামাটির খোল লাগে। এখানেও খোলা মুখ দুটিতে গরু/মোষের চামড়ার ছাউনী লাগানো হয়। ছাউনির মাঝখানে গাব ফলের আঠা বা খিরণ লাগিয়ে চামড়া শক্ত ও টেকসই করা হয়। এছাড়া খোলের উপর তবলার মতন সরু সরু চামড়ার ফিতের বাঁধি লাগানো হয়। নাচ গানের সময় বেশির ভাগ জায়গায়, দুটি মাদল এবং একটি লাগা ব্যবহার করা হয়। তাই দুটি মাদল এবং একটি লাগা নিয়ে মাদলের একটি সেট হয়। আদিবাসী নাচে গানে, ঝুমুর গান এবং নাচে, মাদল বাজবেই।
খোলও একটি পোড়ামাটির বাদ্যযন্ত্র।মৃৎ বা মাটির তৈরি বলে এর আরেকটি নাম মৃদঙ্গ। খোলের আকার অনেকটা কলার মোচার আকৃতির। দুই দিকের খোলা মুখ দুটিতে চামড়ার আচ্ছাদন বা ছাউনী লাগানো হয়। ডানদিকের মুখটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র , বামদিকের মুখের চেয়ে। এখানেও চামড়ার মাঝখানে গাব বা খিরণ লাগান হয়।বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, কীর্তন গানের সঙ্গে খোলের বহুল ব্যবহার করা হয়, তাই একে কীর্তন খোল ও বলে।
রাত একটা বেজে গেছে, , নাচ- গান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছেই। শুনলাম চলবে রাত তিনটে অবধি। অনেকের উপরে দেখলাম দেবতার ভর হয়েছে। তাঁদের ব্যাবহার ও চলন বলন, কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।
ফিরে এলাম ঘরে। সত্যিকারের রাম রাজত্ব দেখতে হলে এই সাঁওতাল গ্রামগুলিতে আসতে হবে। এত লোক রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে, বাইরে থেকে এত লোক এসেছে, বাড়ির সামনে থেকে পিছন অবধি সব দরজা/জানলা খোলা। আমি তো চাঁদের আলোয় শুয়ে পড়লাম, উঠানের খাটিয়াতে। শেষ রাতে শুনি মাথার উপরে মোরগের ডাক। তখনও ঠিকমতন আলো ফোটেনি, কিছু বুঝতে না পেরে, মাথার উপরের আমগাছে ,টর্চের আলো ফেলে চক্ষুস্থির। গাছের উপরে কাতারে কাতারে মুরগি চড়ে বসেছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য, জীবনে প্রথম দেখলাম।
সাঁকোয়া বাজানো হচ্ছে
পরের দিন সকালে এই মুরগি রহস্য উদ্ধার হল। এখানে প্রত্যেকের ঘরেই লড়াকু কাশিপুর মোরগ পোষা হয়। এই মোরগ পোষা হলেও, মোটামুটিভাবে উড়তে পারে। চোর ডাকাত না থাক, মুরগির খোঁজে শিয়াল বা হুরাল প্রায় গ্রামে হানা দেয়। তাই ডারউইন সাহেবের মতকে মেনে নিয়ে এরাও শিয়ালকে কাঁচকলা দেখিয়ে, রাতের বেলা গাছের মগডালে চড়ে বসে থাকে- survival for the fittest .
হ্যাজাকের আলোতে নাচ-গানের মহড়া
তথ্যসূত্র
১) আবাদভূমি, তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬ – এপ্রিল ২০১৭।
২)সুহৃদকুমার ভৌমিক । আর্য্ রহস্য। মনফকিরা।
৩) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বন : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৪) বাংলার জনজাতি, প্রদ্যোত ঘোষ। পুস্তকবিপণি।

বীরভূম জেলার সিউড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাজাল এর নামে মেলা

 বীরভূম জেলার সিউড়ির বড়বাগানের আব্দারপুর ফুটবল ময়দানে আয়োজিত হতে চলেছে ‘বীরবান্টা বাজাল মেলা-২০১৯’। ১৯শে জানুয়ারি এই মেলা আয়োজিত...