সোহরায়
আদিবাসী জনগোষ্ঠি সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সহরায়। সহরায় উৎসব হয়ে থাকে
কার্তিক মাসে। তাই সাঁওতালি বর্ষপুঞ্জিতে কার্তিক মাসকে ‘সহরায় বঙগা’ বলে।
তবে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সাঁওতালরা পৌষ মাসে সহরায় পালন করে থাকে।
সাম্প্রতিক পৌষ সংক্রান্তিতে সারা বাংলাদেশের সাঁওতালদের মাঝে একযোগে
সহরায় পালনের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সহরায় উৎসবে মানুষসহ গৃহপালিত
প্রাণিরও মঙ্গল কামনা করা হয় ঠাকুর জিউ-ঠাকরাণ(স্রষ্টা) এবং
বঙগা(দেবতা)দের কাছে।
সময়
সান্তালদের
সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব সহরায়।এই উৎসব কার্তিক(অক্টোবর-নভেম্বর) ও
পৌষ(ডিসেম্বর-জানুয়ারি) মাসে হয়।প্রথমটিকে বলা হয় 'সারি সহরায়' এবং
দ্বিতীয়টিকে বলা হয় 'সাকারাত সহরায়'। কেন এবং কখন থেকে এই বিভক্তি এ
সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়না। তবে ধারণা করা হয় অর্থনৈতিক কারনেই
এই বিভক্তি হতে পারে। তবে প্রতি বছর যেকোন একটি পালন করা হয়ে থাকে।
পালনরীতি
বিভিন্ন
দলিল, শ্রুতি ও সহরায় গান থেকে জানা যায় সান্তাল সমাজে সহরায় পাঁচ
পর্বের।এই পাঁচ পর্ব পাঁচ দিন ধরে পালন করা হয়। সময়ের প্রয়োজনে অনেক
গ্রামেই তিন দিনে এই পাঁটি পর্ব পালন করা হয়ে থাকে। পর্ব গুলো হলো-
- উম
- দাকা
- খুন্টাউ
- জালে
- সাকরাত
উম
সহরায়ের
প্রথম দিনকে বলা হয় ‘উম মাহা’ যার অর্থ শুচিকরণ বা পবিত্র দিন। এই দিনে
ঘরবাড়ি ও পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার করার কাজ সমাপ্ত হয়। এই দিনে গ্রামের
বাইরে যেকোনো জায়গায় অস্থায়ী পূজার স্থান নির্ধারণ করা হয়। যাকে বলা
হয় ‘গট’ বা ‘গট টৗন্ডি’। নায়কে(পুরোহিত)সহ গ্রামের সকালে স্নান করে নতুন
পোশাক পরে গট টৗন্ডিতে যায়। সেখানে নায়কে কলা, বাতাসা অন্যান্য ফলে
প্রসাদ দিয়ে পূজা করেন এবং গ্রামের সব বাড়ি থেকে নিজ নিজ নিয়ে আসা কবুতর
অথবা মুরগি স্রষ্টা ও দেবতার নামে উৎসর্গ করেন। কোথাও সবার অনুদানে কবুতর ও
মুরগি কেনা হয়ে থাকে। গ্রামের সকল মানুষ ও গাবাদি পশু এতদিন সুস্থ ছিল সে
জন্য নায়কে সেখানে ঠাকুর-ঠাকরান ও মারাং বুরু(প্রধান দেবতা) সহ সকল
বঙগাদের ধন্যবাদ জানান এ সময় । সেই সাথে ভবিষতের মঙ্গল কামনা করেন। তারপর
কুডৗম নায়কে(সহকারী পুরোহিত) একটু পৃথক জায়গায় প্রার্থনা করেন গ্রামে
যেন কোন রোগ, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না আসে। সেই সাথে প্রার্থনা
করেন বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত সাঁওতালসহ বিশে^র সকল মানুষের মঙ্গল। তারপর
উৎসর্গকৃত মুরগি ও কবুতর দিয়ে পোলাও তৈরি করা হয় গ্রামের সকলের জন্য।
দুপুরের খাওয়া হয় সেখানেই। এরপর বাইরে চরানো গ্রামের গাবাদি পশুগুলোকে
নিয়ে আসা হয় পূজার স্থানে। পূজার জন্য ব্যবহৃত কলার পাতা যে গাবাদি পশু
খাবে তাকে মাথায় সিঁদুর দেওয়া হয়। তার মালিককে সুভাগ্যবান মনে করা হয়।
কেননা এটাকে ঐ ব্যক্তির ভবিষৎ মঙ্গলের লক্ষণ মনে করা হয়। সেই খুশিতে মালি
পরের বছরের সহরায়ে বড় কোনো অনুদান দেওয়ার কথা দেন। তারপর সবাই নাচ গান
করতে করতে গ্রামে ফিরে আসে। সব শেষে বাড়িতে এসে প্রত্যেক বাড়ির গৃহ কর্তা
নিজ নিজ বাড়ির ভেতরে মারাং বুরু
ও পরিবারে মৃত ব্যক্তিদের আত্মার উদ্দেশ্যে হান্ডি(বিশেষ ধরনের পানীয়)
উৎসর্গ করে এবং তারাও যেন তাদের জগতে আনন্দের সাথে সহরায় করে এই কামনা
করে। তারপর অবশিষ্ট্য হান্ডি পরিবারের সবাইকে দেওয়া হয়।
দাকা
সহরায়ের
দ্বিতীয় দিনকে বল হয় বঙগা মাহা(দেবতা দিবস) ও দাকা মাহা(ভোজ দিবস)। এই
দিনে প্রতি বাড়িতেই আত্মীয় সজন চলে আসে। এই দিনে বিশেষ গুরুত্ব পান মেয়ে
জামাই। তাকে পা ধুয়ে বরণ করা হয় এবং নতুন কাপড় উপহার দেওয়া হয়। পা
ধোওয়ার দায়িত্ব থাকে শালীকার। অনুপস্থিতিতে বাড়ির অন্য মহিলারা দায়িত্ব
পালন করে। এই দিনে ব্যাপক খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকাল থেকে
সন্ধ্যা পর্যন্ত জগমাঞ্জহির বাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে
আর এক প্রান্ত পর্যন্ত নাচ গান হয়। আবার জগমাঞ্জহির বাড়িতে গিয়েই সমাপ্ত
করা হয়।
খুন্টাউ
সহরায়ের
তৃতীয় দিনকে বলা হয় ‘খুন্টাউ’ যার অর্থ গাবাদি পশুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য
বাইরে বেধে রাখা। এর আগের দিন ময়দা পানি দিয়ে গোওয়াল ঘরের দুওয়ারে
সাঁওতালদের পদবী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ নকশা আঁকা হয়। এই দিন সকালে
গাবাদি পশুর মাথায় শিঙে ধানের শিশের মাল পিঠা বেধে দিয়ে বের করে দেওয়া
হয়। তারপর নায়কে, জগমাঞ্জহি ও অন্যান্য দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিসহ
গ্রামের অনেকে বাড়ি গিয়ে গোওয়াল ঘরের সামনে গাবাদি পশুর মঙ্গল কামনা করে
গানের মাধ্যমে বন্দনা করে। প্রতি বাড়িতেই তাদের আপ্যায়ন করা হয়। এই
দিনও বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জগমাঞ্জহির বাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের
এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত নাচ গান হয়। আবার জগমাঞ্জহির
বাড়িতে গিয়েই সমাপ্ত করা হয়।
জালে
সহরায়ের
চতুর্থ দিনকে বলা হয় ‘জালে’ যার অর্থ তৃপ্তি ভোরে খাওয়া। এই দিনে সবাই
সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে হান্ডি পান করে। এই দিনও বিকাল থেকে সন্ধ্যা
পর্যন্ত জগমাঞ্জহির বাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আর এক
প্রান্ত পর্যন্ত নাচ গান হয়। তবে জগমাঞ্জহির বাড়িতে না গিয়ে
মাঞ্জহি(গ্রাম প্রধান)র বাড়িতে গিয়েই সমাপ্ত করা হয়। এই দিন মাঞ্জহির
বাড়িতে পিঠা ও মুড়ি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। যারা হান্ডি পান করে
তাদের হান্ডি দেওয়া হয়।
সাকরাত
সাকরাত
কে ভিন্ন উৎসব হিসেবেও পালন হয়ে থাকে। তবে যে সব জায়গায় কার্তিক মাসের
পরিবর্তে পৌষ মাসে সহরায় পালন করা হয় সেখানে এই চারটি দিনের সাথে আর একটি
দিন যুক্ত করা হয়। সেটা হলো ‘সাকরাত’ যা অর্থ সমাপ্তি বা সংক্রান্তি। এই
সাকরাত উৎসবের মাধ্যমে সাঁওতালি বর্ষে সমাপ্ত হয়। এই দিনে গ্রামরে
পুরুষেরা শিকার করতে যায়। শিকার থেকে ফিরে এসে নাচ গানের মাধ্যমে তাদের
গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর হাত পা ধুয়ে যে যার বাড়ি যায়। তারপর তীর
ধনুক নিয়ে ‘বজহা তুঞ’ করতে যায়। বজহা তুঞ হচ্ছে একটি কলা গাছকে অশুভ
শক্তির প্রতীক হিসেবে তার উদ্দেশে তীর নিক্ষেপ করা। যে কলা গাছকে তীরবিদ্ধ
করতে পারে তাকে জগমাঞ্জহি ঘাড়ে করে গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে আসে। কলাগাছকে ৭টি
ভাগে ভাগ করে নাগরা বাজাতে বাজাতে গ্রামরে দায়িত্ব প্রাপ্ত সাত
জনের(নায়কে, জগমাঞ্জহি, মাঞ্জহি, পারানিক, জগপারানিক, গডিৎ, কুডৗম নায়কে)
বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
আবার কোথাও কোথাও এই পাঁচ দিনের সাথে আরও একদিন পালন করা হয়। যাকে বল হয় 'হাকো কাটকম' যার অর্থ 'মাছ কাকড়া'। এই দিনে দল বেধে মাছ ধরতে যায় গ্রামের অনেকেই।
সব শেষে বলা যায় সহরায় উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই উৎসবে শুধু
মানুষে অংশগ্রহণে পূর্ণতা লাভ করেনি। এখানে গাবাদি পশুর জন্যও একটি অংশ
রাখা হয়েছে। কেননা এই গাবাদি পশুর মাধ্যমে চাষ আবাদ থেকে শুরু করে একটি
পরিবারের অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। আপদ বিপদ থেকে গাবাদি পশুর
বিনিময়ে অনেক সময় মানুষ মুক্তি পায়। সহরায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়
শুধু মানুষ নয় সকল প্রাণিই প্রকৃতির সন্তান। তাই সব আনন্দই সবার মাঝে ভাগ
করা উচিৎ।
তথ্যসূত্র
- হড়কোরেন মারে হাপড়াকো রেয়াঃ কাথা
- সারি ধরম - সোমাই কিস্কু