SANTHALDISHOM(সানতাল দিশোম): 01/17/20

Friday 17 January 2020

২২_২৩শে_জানুয়ারি_বৌজাল_স্মরণ_মেলায়_দেশবিদেশের_গুণীজন_আগমনে_নক্ষত্র_সমাবেশ_হতে_চলেছে_সিউড়ি।



সাঁওতাল আদিবাসীরা চিরকাল স্বাধীনচেতা।মৌর্য, গুপ্ত,পাল বা সেনযুগে তাঁরা স্বাধীন ছিলেন এমনকি পাঠান বা মুঘলদের সময়েও তাঁদের স্বাধীন বিচরণ ব্যাহত হয়নি।বিভূতিভূষণের আরণ্যকে আমরা সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্নাকে দেখেছি।সাঁওতালরা তাঁকে এবং তাঁর বংশধরদের রাজা মানলেও সেখানেও নিয়মিতভাবে খাজনা দেওয়ার প্রথা ছিল না। ছিল রাজাকে শ্রদ্ধার উপহার দেওয়ার রেওয়াজ।স্মরণাতীত কাল থেকে পাঠান মুঘল যুগ পর্যন্ত এমনকি ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকেও সাঁওতালদের খাওয়াপরার অভাব ছিল না।প্রয়োজন হলেই বনজঙ্গল পরিস্কার করে তাঁরা কৃষিজমি তৈরি করে নিতেন।এছাড়া বনজঙ্গলে নানারকম ফলমূল ও শিকারও পাওয়া যেত। কিন্তু বেনিয়া ব্রিটিশ কোম্পানির সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আদিবাসী সাঁওতালরা শোষনের শিকার হয়ে পড়েন।কোম্পানির লোকজন সাঁওতালদের কাছে খাজনা দাবি করে বসে।খাজনা আদায়ের নামে সহজ সরল শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে।সাঁওতালরা কোনদিনই ইংরেজ শাসনকে ভাল চোখে দেখেননি।প্রথম যে মানুষটি ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন তাঁর নাম বাবা তিলকা মাঁঝি(মুর্মু)। তিলকা মুর্মুর নেতৃত্বে ১৭৮৪ সালে সাঁওতালরা প্রথম ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।একবছর ধরে তাঁরা কোম্পানির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালান। শেষপর্যন্ত তিলকা ধরা পড়েন।ইংরেজ বাহিনী তিলকা মাঁঝিকে ভাগলপুরে ধরে এনে তাঁকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করে।শহীদ তিলকার কথা ইতিহাসে সেভাবে লেখা হয়নি,লেখা হয়নি ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস। প্রকৃত ইতিহাস লেখা হলে সাঁওতাল বিদ্রোহকে ঐতিহাসিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বলতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
তিলকা মাঝির পর ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন বর্তমান ঝাড়খণ্ডের বারহেট থানার ভগ্নাডিহি গ্রামে আর একবার বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে।অত্যাচারী জমিদার, মহাজন আর অসাধু ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার মানুষ সিদো-কানহুর নেতৃত্বে ইংরেজদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালান।হাজার হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীর প্রচণ্ড আঘাতে সেদিন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ইংরেজ বাহিনী বারবার পরাজয়ের মুখে পড়ে।শেষপর্যন্ত ইংরেজ রাজশক্তির কাছে সাঁওতালরা পরাজিত হয় বটে কিন্তু যে সাহস তাঁরা দেখিয়েছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না।সিদো-কানহুর নেতৃত্বে এই সংগ্রাম যেভাবে সাঁওতাল পরগনা,বীরভূম, বর্ধমান,মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল তার পিছনে ছিল অনেক সাঁওতাল যুবকের অবদান। ইতিহাসের পাতায় সেসব বীর সন্তানদের কথা লেখা নেই।১৯৭৬ সালে ডঃ ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে যদি 'সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস ' না লিখতেন তবে হয়তো আমরা সিদো- কানহু-চাঁদ-ভৈরবকে বা তাঁদের আন্দোলনকে এভাবে জানতে পারতাম না।আজও যেমন অনক বীর সাঁওতালদের কথা আমরা জানি না।বৌজাল সরেনও তেমনি একজন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক।ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কালহাজোড় গ্রামের সন্তান। সিদো-কানহুর ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহাজন,সুদখোর, আর অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে। অত্যাচারী,চরিত্রহীন,সুদখোর রূপসিং তামুলীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি তাকে হত্যা করেন।এই বৌজাল সরেন ছিলেন একজন শিল্পিও।অসাধারণ বাঁশি বাজাতে পারতেন।বাজাতে পারতেন বেহালা। যাঁর বাশির সুরে মোহিত হয়ে পড়তো হাজার হাজার মানুষ সেই মানুষটি তামুলী হত্যার দায়ে ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।তাঁকে কালহাজোড় থেকে সিউড়ি জেলে নিয়ো আসা হয়।ঠিক সেইসময় বৌজাল বা বাজাল সরেনের রত্নগর্ভা মা বাজালকে জিজ্ঞেস করলেন -
"তকয় হুকুমতে বাজাল,তকয় বলেতে.."
সেই হৃদয়বিদারক গানের বাংলা তর্জমা করলে মোটামুটি এরকম দাঁড়ায় -
"কার হুকুমে বাজাল তুমি রূপসিং তামুলিকে হত্যা করলে"?
বাজালের উত্তর ছিল-" সিদোর হুকুমে মাগো কানহুর কথাতে"।
মা জিজ্ঞেস করলেন-" তোমার হাতে শিকল পায়ে বেড়ি বাজাল তুমি যাচ্ছ জেলখানায়।
বাজালের নির্ভীক উত্তর -" শিকল নয় মাগো এ আমার হাতের বাঁশি, বেড়ি নয় মাগো এ আমার পায়ের নূপুর, জেলখানায় নয় মা,আমি যাচ্ছি সিউড়ি বড়বাগানের মেলা দেখতে"।
কী অসম্ভব সাহাস ছিল বীরবান্টা বৌজালের।সেই কথা সেই গানের সুরের কথা ইতিহাসের পাতায় না থাকলেও আছে হাজার হাজার সাঁওতালের হৃদয়ে।মুখে মুখে সে গান আজ বহুল প্রচলিত এবং প্রচারিত।
সিউড়ি জেলখানাতে যাওয়ার পর বাজালের কী হয়েছিল সে নিয়ে মতান্তরের শেষ নেই।কেউ বলেন তাঁকে কালাপানিতে নির্বাসনে পাঠানো হয় কেউ বলেন তাঁর বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে জেলার সাহেব তাঁকে নিয়ে লণ্ডনে চলে যান।কেউ বলেন জেলার সাহেবের স্ত্রীর বা কন্যার অনুরোধে বাজালকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁরা বাজালের বাঁশিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন।তাঁরা শিল্পীর কদর বুঝতেন।তবে সবটাই কিংবদন্তী। আসলে বাজালের জেল পরবর্তী জীবনের সঠিক বিবরণ কেউ দিতে পারেননি।বাজাল যেন নেতাজী সুভাষ। সুভাষকে নিয়ে যেমন আলোচনার শেষ নেই,সাঁওতাল সমাজেও তেমনি বাজালকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।সুভাষের মতোই একটা কথা বলা যায়-" বাজাল ঘরে ফিরে নাই"। সুভাষের মতো বাজালও ব্রিটিশ বিরোধী বীর নায়ক।তিনি মিথ হয়ে থেকে যাবেন এলাকার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।
বীরবান্টা বৌজালকে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকার।বৌজাল সরেনের জীবনকথা সাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বীরভূমের সিউড়ির আব্দারপুরের আদিবাসী সুসার গাঁওতার সদস্যরা এক বিরাট মেলার আয়োজন করেছেন।মেলাটি ২২ এবং ২৩ শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সিউড়ি আব্দারপুর ফুটবল ময়দানে। অনুষ্ঠানটির সার্বিক সাফল্যের জন্য দেশবিদেশের গুনীজনরা আসছেন সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করবেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মাননীয় রবিন সরেন মহাশয়।বিশেষ অতিথি হিসাবে থাকছেন নেপালের বিশিষ্ট গুনীজনরা।উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সারদা প্রসাদ কিস্কু,তেতরে পত্রিকার সম্পাদক মহাদেব হাঁসদা,সিলি পত্রিকার সম্পাদক কলেন্দ্রনাথ মাণ্ডী,সার সাগুন পত্রিকার সম্পাদক মলিন্দ হাঁসদা,থাকছেন আসেকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক সুবোধ হাঁসদা।এছাড়াও থাকছেন ডাঃ সুরজিত সিং হাঁসদা,গোড্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা হোলিকা মারাণ্ডি সহ বিশিষ্ট অধ্যাপক,কবিসাহিত্যিক, পত্রপত্রিকার সম্পাদক এবং বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা।দুদিনই বেলা বারোটার পর শুরু হবে গুনীজনদের সম্বর্ধনা এবং তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য। বিকাল পর্যন্ত চলবে সেমিনার। বিকালের দিকে থাকছে বিভিন্ন নৃত্যদলের নৃত্য পরিবেশন। সন্ধ্যা ছ'টার পর বৌজাল সরেন এবং হুলের নায়কদের স্মরণে নাটক।রাত্রী আটটার পর সংগীতের অনুষ্ঠান। সংগীত পরিবেশন করবেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কল্পনা হাঁসদা,রথীন কিস্কু,কেরানী হেমব্রোম, স্টিফেন টুডু প্রমুখ।
বিশদে জানতে যোগাযোগ করতে পারেন আয়োজন কমিটির সম্পাদক চন্দ্রমোহন মুর্মুর সাথে।আরেকজনের কথা না বললে লেখাটি অসম্পূর্ন থেকে যাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী গাঁওতার সম্পাদক রবীন সরেন।এই সাহিত্যানুরাগী সমাজসেবী মানুষটি সুসার গাঁওতার এই আয়োজনের একজন অন্যতম সহযোগী।
বীরবান্টা বৌজালের কথা বিশদভাবে জানতে চলুন ২২ আর ২৩ জানুয়ারী সিউড়ি আব্দারপুর থেকে ঘুরে আসি।আসছেনতো? সুসার গাঁওতার সদস্যরা কিন্তু আপনার অপেক্ষায় থাকবেন ।
Image may contain: people standing and outdoor

বীরভূম জেলার সিউড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাজাল এর নামে মেলা

 বীরভূম জেলার সিউড়ির বড়বাগানের আব্দারপুর ফুটবল ময়দানে আয়োজিত হতে চলেছে ‘বীরবান্টা বাজাল মেলা-২০১৯’। ১৯শে জানুয়ারি এই মেলা আয়োজিত...