আদিবাসী বীরসম্রাট হুদুড়দুর্গার কাহিনী🍁
- - - দুর্গা সাঁওতাল ভাষায় পুংলিঙ্গ। এর স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি দূর্গী। সাঁওতালী লোকসাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে যে তাঁদের রাজা দুর্গার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের মত। ঝড়ের মত(প্রচন্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস বা ঝড়কে সাঁওতাল ভাষায় হুদুড় বলে)তাঁর গতি। তিনি ছিলেন পরাক্রান্ত বীর। আর্য সেনাপতি ইন্দ্র চাইচম্পাগড় আক্রমণ করে হুদূর দুর্গার হাতে পর্যুদস্ত হয়। পরপর সাতবার আক্রমণ করে পরাজিত হওয়ার পরে ইন্দ্র বুঝতে পারেন যে সরাসরি যুদ্ধে হুদুড়দুর্গাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই ছলনা এবং কৌশলের আশ্রয় নেন ইন্দ্র। হুদুড়ের রণকৌশলের মধ্যে কোন দুর্বলতা আছে কিনা এই খোঁজ শুরু করেন ইন্দ্র। ইন্দ্র জানতে পারেন যে অসুর নিয়ম অনুসারে এ দেশের রাজারা আশ্রিতের সাথে, শিশুর সাথে, দিবাবসানে, রাত্রে এবং নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। সুযোগ পেয়ে যান ইন্দ্র। তিনি লাবণ্যময়ী বারাঙ্গনা “দেবী”কে উপঢৌকন হিসেবে হুদূরদুর্গার কাছে প্রেরণ করেন। এক মহিষী থাকতে দ্বিতীয় নারীকে গ্রহণ করা যায় না এই অসুরনীতি মেনে দেবীকে প্রত্যাখ্যান করেন হুদূরদুর্গা। ইন্দ্র এবার নিজেই সন্ধির প্রস্তাব দেন। ঠিক হয় বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাঁরা বৈরিতা দূর করবেন। বিশ্বাস অর্জনের জন্য দেবীর সাথে হুদুড়দুর্গার বিয়ের প্রস্তাব দেন ইন্দ্র। হুদুড়দুর্গা আবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইন্দ্র জানান যে হুদুড়দুর্গা দেবীকে প্রত্যাখ্যান করলে লোকে তাঁর পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। উপায়ান্তর না ভেবে হুদূড়দুর্গা দেবীকে বিয়ে করতে রাজি হন।
ইন্দ্রের আসল উদ্দেশ্য ছিল দেবীর মাধ্যমে হুদুড়দুর্গার দুর্বল মুহূর্তগুলির খোঁজ নেওয়া এবং সেই সুযোগে তাকে হত্যা করা। দেবীর মাধ্যমেই ইন্দ্র জানতে পারেন যে একমাত্র রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে হুদুড়দুর্গা শস্ত্র খুলে রাখেন এবং তার দুর্ধর্ষ রক্ষীরা কাছে থাকে না। বিয়ে করার অষ্টম দিনে হুদূড়দুর্গাকে হত্যা করার কৌশল ঠিক করে নিলেন ইন্দ্র। তিনি দেবীকে জানালেন যে নবমীর রাতেই হুদূড়কে হত্যা করতে হবে। তাকে কামাসক্ত করে সুরাসক্ত করে মহাঘোরের মধ্যেই হত্যা করতে হবে। আদিবাসীদের বিশ্বাস নবমীর রাতেই দেবী নিজে আকন্ঠ সুরাপান করে এবং হুদুড়দুর্গাকে সুরাসক্ত অচৈতন্য করে তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেয় এবং পরেরদিন ভোর রাতে তার দেহকে ইন্দ্রের শিবিরে নিয়ে আসে। হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করার ফলে তার নাম হয় “দেবীদুর্গা”
#পারস্যের বারাঙ্গনা দেবী
এই নিয়ে লোকসাহিত্যে নানা কাহিনী রয়েছে। একটি কাহিনীতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্র মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যের বিখ্যাত বারাঙ্গনা অ্যানার সাহায্য গ্রহণ করেন। উল্লেখ থাকে যে, এই অ্যানা "কাম ও যুদ্ধের দেবী"। আবেস্তা গ্রন্থে এই "দেবাস"দের শয়তানের অংশে জাত বলা হয়েছে। লোককথায় বলা হয়েছে যে, বারাঙ্গনা অ্যানা মহিষাসুরকে কামাসক্ত করে অচৈতন্য অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। তাছাড়া দুর্গা প্রতিমার পরিকল্পনায়ও হুবহু উঠে এসেছে অ্যানার প্রতিচ্ছায়া। দুর্গার সিংহবাহিনী রূপ, হাতের আয়ুধ সব কিছুই অ্যানার প্রতিরূপ। গবেষকেরা এইখানেই দেবাসুরের দ্বন্দ্বের মধ্যে আর্য এবং অনার্যের একটি চিরায়ত লড়াইয়ের সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন।
আর একটি উপকথায় পাওয়া যায় এই নারী ছিলেন ইন্দ্রের নিজের বোন দেবী। অন্যদিকে ভীল আদিবাসীরা দাবী করেন দুর্গা তাদের মেয়ে। দেবতারা তাকে শিবিরে নিয়ে গিয়ে মহিষাসুরকে হত্যা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। দেবীর আর এক নাম চণ্ডী। হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দাবী চণ্ডী তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাকে দিয়ে তাঁদেরই রাজাকে হত্যা করে। এখনো হাঁড়ি সম্প্রদায়ের চণ্ডী পূজায় কোন ব্রাহ্মণ ব্যবহার করা হয় না।
সাঁওতালরা দাঁশায় গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন যে হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে ইন্দ্র চাইচম্পাগড় বা হড়প্পা থেকে আদিবাসীদের বিতাড়িত করেন। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে নারীর ছদ্মবেশ ধারন করে “ইয়ায় নায়ে দিশম চাম্পা” বা সপ্ত নদীর দেশ হড়প্পা থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশ হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আজও তাঁরা বুক চাপড়ে ও হায়রে-ও হায়রে আওয়াজ করে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। দেবী দূর্গার হাতে হুদুরদুর্গা বা মহিষাসুরের হত্যার কাহিনী এভাবেই লোকায়ত হয়ে আছে আদিবাসীদের মধ্যে। আদিবাসী সত্তায় রাজত্ব হারানোর স্মৃতি এখনও সমান ভাবেই বর্তমান।
#পৌরাণিক কাহিনীতে মহিষাসুরঃ
আদিবাসীদের এই লোকসাহিত্যের অনেকটাই সমর্থন পাওয়া যায় নানা পুরাণ কাহিনীতে। শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দোর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা”। অর্থাৎ দুর্গা নামক অসুরকে বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা হলেন।
দেবীপুরানে যে ঘোড়াসুরের বর্ণনা পাওয়া যায় তা হুদুড়দুর্গাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। 'সার্বনি' নামে অষ্টম মনুর মন্বন্তরের সময় যখন পুরন্দর দেবতাদের ইন্দ্র হয়েছিলেন (মার্কন্ডেয় পুরান 80 অঃ) সেই সময় রম্ভাসুরের পুত্র ' ঘোরাসুর' কুশদীপের অধিপতি ছিলেন। সেই ঘোরাসুরই মহিষাসুর নামে খ্যাত (দেবীপুরান- 1ম অঃ)। তিনি নিজে বাহুবলে জম্বুদ্বীপ, ক্রোঞ্চদ্বীপ, শাল্মদ্বীপ, পুস্করদ্বীপ, মানসদ্বীপ (স্বর্গ) ও নাগরাজ (পাতাল) জয় করে সপ্তদীপ ও সপ্তসমুদ্রের অধিপতি ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন বলবান, বীর্যবান, বুদ্ধিমান, ও সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শি তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ন, সংযমী, বিলাসহীন, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতাবাদের আদর্শে প্রজাহিতৈষী। প্রজাগন শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বুকের মধ্যে খোদাই করে রাখত (দেবি পুরান -2 ও 16 তম অঃ)। পরস্ত্রী কে তিনি সর্বদা কন্যা ও মাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন (দেবিপুরান ষোড়ষ অধ্যায় শ্লোক নং 2-12) । তার মতো সর্বগুন সম্পন্ন মহান রাজা মহাভারত, রামায়ন এমনকি অনান্য পুরাণ কাহিনীগুলিতেও দ্বিতীয় কোনো রাজার পরিচয় পাওয়া যায় নি। কেবলাত্র রাজা হরিশচন্দ্রের মধ্যে কিঞ্চিৎ এই গুন থাকলেও হরিশচন্দ্রের তুলনায় তিনি বহুগুনে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
কোন সর্বগুণ সম্পন্না, কল্যাণময়ী নারীকে যেমন মহিষী বা মহিয়সী উপাধী দেওয়া হয় তেমনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে ঘোড়াসুরকে মহিষ , মহিয়ষ তথা (মহিষ+ অসুর ) মহিষাসুর উপাধি তে ভূষিত করা হয়েছিল। পরবর্তী কালের পুরাণগুলিতে বিশেষ করে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং ইদানীং কালের মহিষাসুর মর্দিনীতে মহিষাসুরকে মহিষের গর্ভজাত অথবা মহিষেররূপী এক মায়াবী এবং দুরাচারী অসুর হিসেবে দেখানো হয়। মূলত দুর্গা শক্তির নামে এক ব্রাহ্মন্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর জন্যই জনকল্যাণকারী, মঙ্গলময় আদিকৌম সংস্কৃতির মহান রাজা হুদুড় দুর্গা, ঘোড়াসুর বা মহিষাসুরকে 'অশুভ শক্তি'র প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পণ্ডিতেরা বলছেন, অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশ নাকি দুর্গা পূজার অন্যতম অভিধা। কিন্তু এই ধাঁধার যথার্থ উত্তর খোঁজা প্রয়োজন বলে মনে করি। মনে করি যে আমাদের খুঁজে দেখা উচিৎ বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে কারা এই অশুভ শক্তির প্রতীক! কাদের দুর্দম্য, দুর্বিনীত আচরণের জন্য সাম্যবাদের এই মহান ভূমি কলুষিত হয়েছে বার বার? কারাই বা নারীকে ক্লেদাক্ত পঙ্কে নিক্ষিপ্ত করেছে। কারা নিমজ্জিত হয়েছে লুন্ঠন, ধর্ষণ ও জিঘাংসায়? কারা পূজার অছিলায় দুর্গা শক্তির নামে সমগ্র নারীসমাজকে গণিকার পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে? কারা এখনো পর্যন্ত নারীকে নরকের দ্বার মনে করে? কারাই বা শুধুমাত্র পুত্র কামনার্থে নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে? কারাইবা নারীকে বহুগামিতা ও বহুবিবাহে প্রলুব্ধ করে?
এই সমস্ত কাজ যদি সমাজ বিকাশে অকল্যাণকারী হয় এবং এদেরকেই যদি অশুভ শক্তির ধারক বাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়; তবে নিশ্চিত ভবেই ভারতের ব্রাহ্মন্যবাদ এই অশুভ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মহিষাসুর স্মরণ সভা। রাজ্যের প্রতিটি আদিবাসী গ্রামে পূর্ণ উদ্যমে দাঁশাই পালন করার জন্য প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে মূলনিবাসী-বহুজন সমাজ। সমগ্র রাজ্যের অনুষ্ঠানগুলিকে একসূত্রে গাঁথার জন্য গঠিত হয়েছে “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অসুর স্মরণসভা কমিটি”। এই কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, অসুর সংস্কৃতির শিকড়ের অণুসন্ধানই তাদের মূল উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদীদের মদতে দুর্গাপূজার অছিলায় যে সাম্রাজ্যবাদী, ভোগবাদী এবং আগ্রাসী শক্তি ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাতে বহুজন সংস্কৃতিতে নেমে এসেছে এক অস্তিত্বের সংকট। মহিষাসুর স্মরণ সভা সেই স্বাধিকার এবং শিকড়ের সন্ধানের এক সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই জাগরণ ভাবি কালের জন্য এক নব নির্মাণের ইঙ্গিত বহন করছে।
“দাঁশায়” আদিবাসীদের একটি শোকপালনের ব্রত। পাঁচদিন ধরে চলে এই শোক পালন। এই শোক পালন হয় নাচ, গান এবং ভিক্ষার মাধ্যমে। ভিক্ষা বৃত্তি সাঁওতাল সমাজে এক সামাজিক অপরাধ হলেও দাঁশায়ের দিনগুলিতে তাঁরা প্রতীকী ভিক্ষা করে। বুক চাপড়ে ও হায়রে, ও হায়রে ধ্বনি তুলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ করে। এই নাচকে বলা হয় “দাঁড়ান ভুয়াং” নাচ। লাউয়ের শুকনো বসের উপর ধনুকের মত ভুয়াং বাদ্যযন্ত্রতে টঙ্কার তুলে এই আর্তনাদ আসলে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া রাজার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরা বিশ্বাস করে “দেবী” নামে কোন এক গৌরবর্ণা নারী তাঁদের রাজাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে গোপন ডেরায় অথবা তাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেছে। এই দাঁশায় নাচের সমস্ত পুরুষেরা নারীর ছদ্মবেশে সজ্জিত হয়ে নেয়। পরনে শাড়ি, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করেন তাঁরা। শোনা যায় তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাজা হুদুরদুর্গা বা ঘোড়াসুরকে সব সময় ঘিরে থাকত সাত জন বীর যোদ্ধা। এই যোদ্ধারাই নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে তাদের রাজাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। হাতের শস্ত্রগুলিকে বাদ্যযন্ত্রের আদল দেওয়া হয়। যাতে সন্ধিক্ষনে যুদ্ধ বিজয়ে সেগুলো কাজে লাগে। “হায়রে ও হায়রে” ধ্বনি তুলে তাঁরা টিকটিকি, মাকড়সা গাছপালা, পশুপাখিদের তাঁদের রাজাকে দেখেছে কি না প্রশ্ন করে। সাংকেতিক ভাষায় প্রশ্ন করে এই ভুয়াং এর জন্ম কেমন করে হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই প্রশ্নের উত্তর কেবল হুদুড়দুর্গা বা মহিষাসুরই দিতে পারেন। গানের সুরে তাঁরা প্রশ্ন করেনঃ
"অকারে দ ভুয়াং এম জানামলেনা রে? অকারে দ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে?
খত মাদের রে ভুয়াং এম জানামলেনা রে গড়া সাড়িমরে ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে
চেতে লাগিৎ ভুয়াং এম জানামলেনা রে চেতে লাগিৎ ভুয়াং এম বুসাঁড়লেনা রে
দেশ দাড়ান লাগিৎ ভুয়াং এম জানাম লেনা রে দিসম সাঙ্গার লাগিৎ ভুয়াং এম বুঁসাড়লেনা রে"।
- - - ( সংগৃহিত)।
No comments:
Post a Comment