আদিবাসী সাঁওতাল সম্পর্কে ভারতীয় অ-আদিবাসী জনমানসে একটি বদ্ধমূল ধারণা রাস্তার পাশে মাইল স্টোন পাথরের ন্যায় প্রোথিত আছে যে, আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর ও নিকৃষ্ট জাতি। লেখকঃ— বিশ্বনাথ হেমব্রম, কল্যাণী, নদীয়া।
সমগ্র পৃথিবীর ব্যাপী অবস্থিত প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার, রীতি-নীতি, আচার- অনুষ্ঠান বিদ্যমান। প্রত্যেক জাতির কাছে তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান গুলো জন্মদ্ধাত্রী মায়ের মতন। ‘মা’ এর যেমন কোন তুলনা হয়না বা মায়ের কোন বিকল্প হয়না ঠিক তেমনি। ঐ কৃষ্টি, কালচার, রীতি-নীতি, আচার -অনুষ্ঠান গুলোই নিজ নিজ জাতির তাঁদের সমাজের আয়না বা প্রতিবিম্ব স্বরূপ। তেমনিই ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতাল জাতিরও নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার, আচার- অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি সমূহ বিদ্যমান। যেমন সহরায়, সাকরাত , বাহা, মাঃমঁড়ে, দং, লাগড়ে এনেজ সেরেঞ (নাচ-গান) ইত্যাদি। আধুনিকতম পৃথিবীর মিশ্র সংস্কৃতির প্রবাহে গা নাভাসিয়ে আদিবাসী সাঁওতালরা এখনও নিজেদের কৃষ্টি, কালচার গুলিকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে বা রাখতে পেরেছে। এটি কম কথা নয়, কেননা আমাদের সকলকের জানা যে, সেই আর্যদের ভারত আগমন কাল থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগে আজ অবধি তাঁদের উপর নানান বঞ্চনা, শোষণ, পীড়ন চলছেই। মধ্যবর্তী সময়কাল যদি আমরা পর্যালোচনা করি। তাহলে দেখতে পাবো কত জাতি দ্বারাই না শোষণ, পীড়ন, অত্যাচারিত হয়েছে। যেমন মোঘল, তুর্কি, শক, হুন, পাঠান, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ব্রিটিশ ইংরেজ ইত্যাদি। এতো জাতির বঞ্চনা, গঞ্জনা, শোষণ, পীড়ন সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের কৃষ্টি, কালচার গুলিকে এখনও ধরে রাখতে পেরেছে। এই আদিবাসী সাঁওতাল সম্পর্কে ভারতীয় অ-আদিবাসী জনমানসে একটি বদ্ধমূল ধারণা রাস্তার পাশে মাইল স্টোন পাথরের ন্যায় প্রোথিত আছে যে, আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর ও নিকৃষ্ট জাতি।
পৃথিবীর সৃষ্টিতেই আমরা পৃথিবীর বর্তমান রূপ পাইনি। বহু বিবর্তনের ফলে কয়েক হাজার কোটি বছর পরে পৃথিবীর এই বর্তমান রূপ আমরা পেয়েছি। তেমনি পৃথিবীতে জীবজগৎ ও প্রাণীজগৎ একদিনে উদ্ভব হয়নি। বহু কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে জলজ এককোষী প্রাণী থেকে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বহু কোষী প্রাণীতে রূপান্তর ঘটেছে। বাইলোজিক্যাল বৈজ্ঞানিক মতে পৃথিবীতে পক্ষীকূল আবির্ভূত হবার পর জীব শ্রেষ্ঠ মনুষ্যকূলের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালদের মাইথোলজি (সিরজন বিন্তী) মতে হাঁস -হাঁসলি (হাঁসের পুং, স্ত্রী) থেকেই আদি মানব -মানবী পিলচু-পেলচা (পিলচু হাড়াম, পিলচু বুড়ি) সৃষ্টি হয়েছেন। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে মানবজাতির বৃদ্ধি ঘটেছে। এই জীবজগৎ ও প্রাণীজগৎ সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক মতের সঙ্গে আদিবাসী সাঁওতালদের সিরজন বিন্তী -র (সৃষ্টির ইতিহাস) মিল লক্ষণীয়। তাহলে ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর, নিকৃষ্ট না…….. উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক কোপারনিকাস ও বিজ্ঞানী গ্যালিলিও -র মতবাদকে (সূর্য স্থির, পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে পশ্চিম থেকে পূর্বে) এক সময় ক্ষমতাবলে ও বাহুবলে খর্ব করার চেষ্টা হলেও বর্তমানে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে ও প্রমাণ সাপেক্ষে তাহাই সঠিক প্রমানিত। আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে এই তথ্য বহু যুগ আগে থেকেই প্রমানিত। তাঁদের সমাজের নানা গান, ধর্মীয় কার্যকলাপ ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। যেমন পূজা অর্চনার ‘খন্ড করণ’ প্রক্রিয়া ও নাচের সময় দলবদ্ধ পরিক্রমা পদ্ধতি থেকে তা সহজেই বোঝা যায়। এই দুটি ক্ষেত্রেই পশ্চিম থেকে পূর্বে ক্রিয়াকলাপ আবর্তিত হয়। তাহলে ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর, নিকৃষ্ট না…….. উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
পৃথিবীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক W. W. hunter তাঁর বই ‘The Annuals of Rural Bengal ‘ – এ বলেছেন ‘Aryan roots in Santhali’ এবং বিভিন্ন ভাষাবিদদের মত অনুযায়ী সংস্কৃত ভাষা থেকে যে সমস্ত ভারতীয় ভাষাগুলি সৃষ্টি হয়েছে তাতে সাঁওতালি ভাষার শব্দ 60% বিদ্যমান ও ঐ ভাষাগুলির নিজস্ব শব্দ 40% বিদ্যমান। তাহলে ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর, নিকৃষ্ট না……. উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালরা ১২টি শাখা বা অংশে বিভক্ত। যেমন হাঁসদা, মান্ডী, কিস্কু, মুরমু, হেমব্রম, সরেন, টুডু, বেসরা, বাস্কে, পাউরিয়া, চঁড়ে, বেদেয়া। আবার এই ভাগগুলির প্রত্যেকটি ১২টি উপঅংশে বিভক্ত। তাঁদের সমাজে এখনও প্রচলিত ও সত্য যে কিস্কুরা হচ্ছেন রাপাজ (রাজবংশ) বংশধর, সরেনরা হচ্ছেন সিপাহী (সৈনিক) বংশধর, মান্ডীরা হচ্ছেন কিঁষাড় (ধনী) বংশধর, টুডুরা হচ্ছেন রুসিকা (নাচ গান বিশারদ) বংশধর, মুরমুরা হচ্ছেন ঠাকুর (পুরোহিত) বংশধর। তেমনি এঁদের প্রত্যেকের নিজ নিজ গাঢ় (সাম্রাজ্য, দূর্গ, অঞ্চল, এলাকা) ছিল। যেমন চাঁই গাড়, চম্পা গাড়, কঁয়ডা গাড়, বাদোলী গাড়, খাইরী গাড় ইত্যাদি। তাহলে আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য , বর্বর, নিকৃষ্ট না……. উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে বহু বছর আগে থেকেই গণতন্ত্র বা লোকতন্ত্র ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। এই গনতন্ত্র বা লোকতন্ত্র (মাঝি আরি) ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাঁদের সমাজ পরিচালিত হয়। মাঝি আরি বা মোড়ল ব্যবস্থায় কয়েকটি ধাপ বা শ্রেণীবিন্যাস আছে। যেমন ১) মাঝি, ২) জগ মাঝি, ৩) গডেৎ, ৪) নায়কে ও ৫) পারানিক। তাঁদের সমাজের সমস্ত রকমের কাজকর্ম এই মাঝি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। একটি নবজাতক শিশুর জন্ম গ্রহণ পরবর্তী কাজকর্ম থেকে শুরু করে কোন বিবাহ যোগ্য /যোগ্যা যুবক-যুবতীর বিবাহ কর্মাদি, কোন মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী কাজকর্ম সব কিছুই। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রেও তাঁদের সমাজে সুনির্দিষ্ট বিচার ব্যবস্থা পদ্ধতি বিদ্যমান। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন মহান ব্যক্তিত্ব আদিবাসী সমাজের আইকন জয়পাল সিং মুন্ডার কথা। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না এই মহান ব্যক্তির অবদানের কথা। আমাদের ভারতীয় সংবিধান রচনাকারী যে কমিটি ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আরও এক মহান আদিবাসী ব্যক্তিত্ব ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর জী। সেই কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি জয়পাল সিং মুন্ডা। তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি তুলে ধরলাম ‘আব হাম আদিবাসীয়ো কো লোকতন্ত্র কা পাঠ নাহী পড়া সাকতে, কিউকী লোকতন্ত্র হামারে ইঁহা সাদিয়ো সে মজুদ হেঁ’। তাহলে আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য ,বর্বর ,নিকৃষ্ট না……..উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের অতিথি আপ্যায়ন পদ্ধতি আপনারা লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন পদ্ধতিটির অভিনবত্ব, এটীও বহু প্রাচীন। বাড়ীতে কোন অতিথির আগমন ঘটলে প্রথমেই তাকে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরক্ষণেই জলপূর্ণ ঘটি (কাঁসা পিতলের) তার সামনে উপবেশন করা হয়। তারপর গড জহার (সন্মান জ্ঞাপন পদ্ধতি) প্রদান করা হয়। পরে আগত অতিথির কাছ থেকে ভাল -মন্দের কুশল বিনিময় করা হয়। এছাড়াও আদিবাসী সমাজে কোন শুভ কাজ আরম্ভ করার আগে শুভ প্রতীক হিসাবে জলপূর্ণ ঘটির মধ্যে কয়েকটি আমপাতা যুক্ত আম ডাল রাখা হয়। এতে শুভ কাজের ব্যাঘাত ঘটবে না বলে তাঁদের সমাজের বিশ্বাস। তাহলে ভারতীয় আদিবাসী সাঁওতালরা অসভ্য, বর্বর, নিকৃষ্ট না…….. উৎকৃষ্ট আপনারাই ভাবুন?
পরিশেষে বলব, একটি জাতি অসভ্য, বর্বর ও নিকৃষ্ট-র মাপার মাপকাঠির একক কি আছে বা কি হতে পারে, আমার জানা নেই। আপনাদের জানা থাকলে দয়া করে জানাবেন। যে জাতির সম্প্রদায়ের, সমাজের ঐতিহ্য এতো সুপ্রাচীন ও দৃষ্টিভঙ্গি এতো বিজ্ঞানসম্মত। সেই জাতি, সম্প্রদায়, সমাজের মানুষদের কি অসভ্য, বর্বর, নিকৃষ্ট বলা যায় একটু ভাববেন???
— বিশ্বনাথ হেমব্রম
কল্যাণী, নদীয়া
কল্যাণী, নদীয়া
তথ্য সূত্রঃ– সাঁওতাল গীতি পূরাণ/সিরজন। বিন্তী/জমসিম বিন্তী/জাহের বঙ্গা সান্তাড় ক/The Annuals of Rural Bengal /বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন পুস্তক /সাঁওতাল সমাজের রীতি-নীতি।
No comments:
Post a Comment