SANTHALDISHOM(সানতাল দিশোম): আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কমিটি গড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Friday 13 July 2018

আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কমিটি গড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।



২০১১ সালে প্রথম বার পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতা লাভ করার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তার সরকারের উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে অন্যতম অভিমুখ আদিবাসীরা। আদিবাসীদের উন্নয়নের তদারকি করতে বার বার ছুটে গিয়েছেন জঙ্গলমহল। আদিবাসীদের উন্নয়নে চালু করেছেন অনেক নতুন নতুন সরকারী প্রকল্প। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটেছে। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের ওপর বিরূপ হয়েছেন আদিবাসীরা। বিভিন্ন ইস্যুতে বার বার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পথে নামছেন আদিবাসীরা। আদিবাসীদের দেখাদেখি আরও অনেকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। তার জেরে গত পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গের আদিবাসী প্রধান এলাকায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি শাসকদল। এর প্রতিক্রিয়ায় দলীয় স্তরে অন্তর্তদন্ত, সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক স্তরে ব্যাপক রদবদলের ধারাবাহিকতায় এ বার আদিবাসী উন্নয়নে বিশেষ কমিটি গড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্লক, জেলা এবং রাজ্য – তিন স্তরেই কমিটি তৈরি হবে। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে সিপিএমের বহিষ্কৃত সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
আদিবাসীদের ক্ষোভের কারন ও উন্নয়নের পন্থা খুঁজে বের করতে গত ০৬ ই জুলাই, ২০১৮ (শুক্রবার) দুপুরে নবান্নে বিশেষ বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আদিবাসী অধ্যুষিত ১৫০ টি ব্লক থেকে বাছাই করা আদিবাসীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ছিলেন আদিবাসী উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিরা। হাজির ছিলেন ডিএম এবং এসপি’রা। তবে সরাসরি রাজনীতির লোক বলতে বিধায়ক, সাংসদ এবং পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে গোনা কয়েক জনকেই মাত্র ডাকা হয়েছিল। এই বৈঠকেই আদিবাসী এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে ব্লক, জেলা এবং রাজ্যস্তরে আলাদা কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। কমিটির মুখ্য কাজ হবে, আদিবাসী উন্নয়নে প্রশাসন এবং সরকারকে পরামর্শ দেওয়া এবং পঞ্চায়েতের কাজে তদারকি করা।
রাজ্যের প্রতিটি জেলা থেকে দু’জন করে আদিবাসী প্রতিনিধি রাজ্যস্তরে এই কমিটির সদস্য হবেন। তাঁরা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করবেন। নব গঠিত কমিটির চেয়ারম্যান ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্য আদিবাসী উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। আদিবাসীদের উন্নয়ন কী ভাবে করা যায়, সেটা খতিয়ে দেখে সরকারকে সব রকম সাহায্য করবে কমিটি। আগামী দিনে জেলা এবং ব্লক স্তর পর্যন্ত কমিটির কাজ ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’
২০১১-য় তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর আদিবাসীদের উন্নয়নে একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। রেশনে সস্তার চাল, পাট্টা বিলি, গরিব আদিবাসীদের জন্য পাকা বাড়ি, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, বেকার যুবকদের সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি দেওয়া-সহ একের পর এক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। গঠিত হয়েছে আদিবাসী উন্নয়ন বোর্ড। তার পরেও কেন আবার নতুন করে আদিবাসী উন্নয়ন কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীর?
রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া জেলায় ধাক্কা খেয়েছে শাসকদল। তৃণমূলকে হারিয়ে বহু আসনে জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থীরা। বাঁকুড়া, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাতেও তৃণমূলের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছে বিজেপি। আদিবাসীদের সংগঠিত করতে কিছু দিন আগেই পুরুলিয়ায় সভা করে গিয়েছেন বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। সব মিলিয়েই আদিবাসীদের মুখ ফেরানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে শাসক শিবিরে। আদিবাসীদের সমর্থন ফিরে পেতে এবং মজবুত করতেই পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত আদিবাসী নেতাদের আরএসএস সম্পর্কে সতর্কও করে দিয়েছেন তিনি।
পঞ্চায়েতে তৃণমূলের অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলের জন্য দলের স্থানীয় নেতাদের লাগাম ছাড়া দুর্নীতি এবং বেহিসাবি জীবন-যাপনকে দায়ী করেছেন অনেকে। দলীয় তদন্তেও সেটা উঠে এসেছে। তাই দলের নেতাদের দূরে রেখে আদিবাসী অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সামনে রেখেই আদিবাসী এলাকার উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জঙ্গলমহলের অনেক পরিচিত রাজনৈতিক নেতাই আমন্ত্রণ পাননি বৈঠকে। ঝাড়গ্রামের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী চূড়ামনি মাহাতোকে ডাকা হয়নি। তবে উমা সোরেন, সুকুমার হাঁসদা, শান্তিরাম মাহাতোর মতো তৃণমূলের কয়েক জন আদিবাসী নেতাকে বৈঠকে দেখা গিয়েছে। পঞ্চায়েতের কয়েক জন মাত্র প্রতিনিধি ডাক পেয়েছিলেন। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন ব্লক থেকে গড়ে সাত থেকে আট জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এক দিন আগেই বাসে করে তাঁদের কলকাতায় আনা হয়েছিল। বৈঠকের পর জঙ্গলমহলের নেতারা বাড়ি ফিরে গেলেও উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিরা শহরে সরকারি আতিথেয়তায় রয়েছেন। নতুন কমিটির সদস্যদের ভাতা দেওয়া যায় কিনা, সেই বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে দেখবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
এই কমিটি আপাতত কাজ করবে জনজাতি অধ্যুষিত ১৫০ ব্লকে। বাসিন্দাদের অভাব-অভিযোগ শোনা, আরও উন্নয়ন প্রকল্প করা, চালু প্রকল্পগুলির সুবিধা তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে কি না, তার দেখভাল, সরকার ও আদিবাসী সমাজের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করবে কমিটি। ‘‘বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের নির্যাস, উন্নয়নের সমবণ্টন হতে হবে,’’ বলেন এক মন্ত্রী।
শাসক-নেতাদের একটি অংশের ধারণা, ভেবেচিন্তেই ওই কমিটিতে পরিচিত তৃণমূল নেতাদের রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের যুক্তি, জঙ্গলমহল, বিশেষত আদিবাসী এলাকার ভোটে ফল যে আশানুরূপ হয়নি, তার জন্য অনেকাংশে দায়ী সেখানকার নেতাদের একাংশের ভাবমূর্তি। তাঁদের আচরণ, জনসংযোগ ঠিকঠাক ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তৃণমূল স্তরে না-পৌঁছনোয় ক্ষোভ বেড়েছে। একেবারে নতুন মুখ নিয়ে গঠিত কমিটি আদিবাসী সমাজের মুখ ফেরানো অংশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে আশা করছেন মন্ত্রীদের অনেকেই।
নবান্ন থেকে সব জেলা প্রশাসনকে লিখিত নির্দেশ দিয়েছে, আদিবাসী সমাজের কারও জমি কেনা বা তার চরিত্র বদল করা যাবে না। প্রশাসনের একাংশের অনুমান, আদিবাসী সমাজের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ার অন্যতম কারণ জমির হাতবদল। এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত জনজাতি-প্রতিনিধিদের এই বিষয়টি পৃথক ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে প্রায় ৮০০ প্রতিনিধিকে স্মার্টফোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আদিবাসী সমাজে প্রচলিত সব ভাষায় তৈরি একটি অ্যাপ থাকবে তাতে। সরকারি পদক্ষেপ, প্রকল্পের কথা জানা যাবে তার মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা সেই অনুযায়ী প্রচার করবেন। তথ্য আদানপ্রদানের জন্য তৈরি হবে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। গোটা কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য অবসরপ্রাপ্ত এক আইপিএস-কে ‘নোডাল অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ করবে রাজ্য।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে জানান, ‘আমাদের সরকার সব সম্প্রদায়ের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ হয়েছে। আগামী দিনে তা আরও ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা।’
বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চান, দু’টাকা কেজি চাল, জাতিগত শংসাপত্র এবং উন্নয়নের যে সমস্ত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তার সুবিধা তাঁরা পাচ্ছেন কি না। তখন কয়েকজন নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, জমির পাট্টা দেওয়া হলেও রেকর্ড নেই। সেই রেকর্ড না থাকায় অসুবিধা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী তা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা ঩নিতে বলেন। একজন বলেন, জাতিগত বৈষম্য খুবই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পুজো পার্বণে উচ্চবর্ণের লোকেরা আমাদের সামাজিক বয়কট করে। আমরা একঘরে হয়ে যাই। রীতিমতো ফতোয়া দিয়ে বয়কট করা হয়।
তা শুনে অসন্তুষ্ট হন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে তার কড়া নিন্দা করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বলেছেন, এরকম ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করতে হবে। না হলে তাঁকে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের পক্ষে একজন বলেন, এখনও ডাইনি প্রথা চলছে। এটা বন্ধ করতে পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তাহলে সচেতনতা বৃদ্ধি হবে। সেই সঙ্গে অলচিকি হরফের আরও স্কুল এবং কমিউনিটি সেন্টার তৈরির দাবিও জানানো হয়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য স্কলারশিপ চালু করা হয়েছে। ২০১১ সালের আগে আদিবাসীদের উন্নয়নে ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০১৮ সালে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮৭৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে নতুন দপ্তর তৈরি করা হয়েছে। একইরকমভাবে অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরের বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯০৭ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। আদিবাসীদের পাশে আছে রাজ্য সরকার।
এদিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী, পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, শান্তিরাম মাহাত, সৌমেন মহাপাত্র, অনুব্রত মণ্ডল, মুখ্যসচিব মলয় দে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ করপুরকায়স্থ, ডিজি বীরেন্দ্র, সিপিএমের বহিষ্কৃত সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। এদিন বাসে করে আদিবাসীদের নিয়ে আসা হয়। তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও তা ছিল সামান্য। ব্যয় সঙ্কোচের জন্য মেনুও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

বীরভূম জেলার সিউড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাজাল এর নামে মেলা

 বীরভূম জেলার সিউড়ির বড়বাগানের আব্দারপুর ফুটবল ময়দানে আয়োজিত হতে চলেছে ‘বীরবান্টা বাজাল মেলা-২০১৯’। ১৯শে জানুয়ারি এই মেলা আয়োজিত...